শিরোনাম
◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে বিভেদের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়: ওবায়দুল কাদের  ◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল

প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর, ২০১৮, ০৪:২৭ সকাল
আপডেট : ২৯ নভেম্বর, ২০১৮, ০৪:২৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক

খোন্দকার আতাউল হক : পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক। অন্যভাবে বলা যায় ‘কাকের কিডনি কবুতরকে লাগানোর মতো’। এই কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো রাজনীতি আর গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক এ কথা যেমন সত্য, তেমন এই রাজনীতি আর গণতন্ত্রের মূল আদর্শিক বিষয়বস্তুকে লালন করাও কঠিন। গণতন্ত্রের একটি শৈলী আচরণ আছে জনগণের স্বার্থে। সেই আচরণ রক্ষা করতে গিয়ে রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজও হিমশিম খেয়ে থাকে। যেমন ‘টাকা না থাকার এক জ্বালা, আর টাকা থাকার অনেক জ্বালা’। ঠিক তেমনি নেতাদের নির্বাচনে না জিতলে এক জ্বালা, আর জিতলে বহু জ্বালা। তখন পলিটিক্সও আনরোমান্টিক হয়ে যায়।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ভারতের মধ্যেও গণতন্ত্রের ভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের গণতন্ত্রেও আছে প্রায়োগিকভাবে পার্থক্য। পাকিস্তানে আছে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গণতন্ত্র। আর বাংলাদেশে আছে অসম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যাকে বলা হয় নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। আমেরিকার জনগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে ‘পপুলার’ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকে; সেই গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যহীন। সাংবিধানিক নিয়মে জনমত যাচাইয়ের পদ্ধতি হচ্ছে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে। ইলেক্টোরাল কলেজ মানে নির্বাচনী ভোট। আর পপুলার অর্থাৎ জনপ্রিয়। যার কারণে ২৯ লক্ষ পপুলার ভোট পেয়েও হিলারী ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেক্টোরাল ভোটে ট্রাম করে বিজয়ী হলেন।

তাহলে গণতান্ত্রিক ভোট কোনটা ‘পপুলার’ না ‘ইলেক্টোরাল’? গণতন্ত্র এবং রাজনীতি যখন আনপ্রেডিক্টেবল হয় তখনই পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক। বৃটেনে গণতন্ত্রের আধুনিক নামকরণ হয়েছে ‘ওয়েস্ট মিনিস্টার’। বৃটেনে ‘ওয়েস্ট মিনিস্টার’ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে রাজনৈতিক দল পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হয়, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী সে দল থেকেই হবে। ৫০ বছর ধরেই ‘ওয়েস্ট মিনিস্টার’ (যাকে বলা হয় ‘বহুদলীয়’) গণতন্ত্রের কারণে মোট ভোটের গড় ৪৫% শতাংশ পেয়ে বিজয়ী দল হিসেবে সরকার গঠন করে। এখানেও দেখা যায় জনগণের ভোটাধিকার মূল্যহীন। অথচ এই ইংল্যান্ডকে বলা হয় গণতন্ত্রের জন্মভূমি। ্এখানে বলাই যায় প্রেডিক্টেবল যদি আনপ্রেডিক্টেবল হয়, তাহলে পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক।

ভারতের গণতান্ত্রিক চেহারাটা যদি দেখি, তবে দেখব, ষাটের দশক থেকে আজ অবধি গড়ে শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ীরা সরকার গঠন করেছে। মোট ভোটের শতকরা ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ সরকারবিরোধী থাকার পরও ভারত হচ্ছে বড় গণতান্ত্রিক দেশ? আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ভারতÑ এই তিনটি দেশে গণতন্ত্রের প্রবক্তা আব্রাহাম লিংকনের সেই ‘ফর দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল, অব দ্যা পিপল’ অনুপস্থিত। আর পাকিস্তানে আছে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী গণতন্ত্র। তাহলে গণতান্ত্রিক ভোট কোনটা ‘পপুলার’ না ‘ ইলেক্টোরাল’?

বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র এবং নির্বাচনে না আছে আমেরিকার মত পপুলার ভোট, না আছে ইলেক্টোরাল ভোট, না আছে ইংল্যন্ডের মত ওয়েস্ট মিনিস্টার ভোটিং পদ্ধতি, না আছে ভারতীয় নির্বাচন সিস্টেম। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট ‘এককক্ষ’ বিশিষ্ট। এখানে ভোটের সিস্টেমও একব্যক্তির এক ভোট। বাংলাদেশের এই ভোটিং সিস্টেমকে পপুলার ভোট হিসেবে গণ্য করা ভুল হবে না। কারণ পপুলার ভোটেই তো প্রার্থীরা জয়ী হয় এবং বিজয়ী দল সরকার গঠন করে থাকে। গণতন্ত্রের একটি বৈচিত্র্যময়, সুসম রোমান্টিক চরিত্র আছে। গণতন্ত্রেও বৈচিত্র্য ও শৈলীর আল্পনায় সমাজ, রাষ্ট্র, জনগণ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় অহিংস রাজনীতির জন্ম দেয়। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে শিক্ষা দেয়। কিন্তু মানুষ কাঁকড়ার মতো, তাই সে তার প্রতিদ্বন্দ্বিকে টেনে ধরে। রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে জনগণ সব সময়ই প্রেডিক্টেবল বলে মনে করে।

রাজনীতিবিদদের অরাজনৈতিক, স্বৈরতান্ত্রিক, অসহিষ্ণু ও দাম্ভিক আচরণের কারণে রাজনীতি আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে যায় বলেই তখন নেতাদের কাছে পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক হয়। রাজনীতির পথ দুর্গম, দুস্তর, দুরূহ, দুর্বিসহ, সংকীর্ণ, পঙ্কিল ও পিচ্ছিল। এ এক কণ্টকাকীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ পথ। এ পথে যারা হাঁটছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে ছিটকে জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন। কেউ ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আবার কেউ মুখ থুবড়ে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ ক্ষমতার স্বাদে পাল তুলে নদীতে নৌকা ভসিয়েছে, কেউ ক্ষমতাচ্যুতির বিরহ-বেদনায় দেয়ালে কপাল ঠুকছে, আবার কেউ জেল জরিমানার ভয়ে দেশ ছাড়ছেন। ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতাহীন রাজনীতিকরা জনগণের কাছে দেয়া কমিটমেন্ট রক্ষা করতে পারে না বলেই তখনই তাদের কাছে পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক হয়।

স্বাধীনতার পর দেশ ও জাতির ভাগ্য পাল্টে দেয়ার অঙ্গিকার ছিল। রাজনীতি ও প্রশাসনে ঔপনিবেশিক আমলের মন-মানসিকতার প্রাধান্য থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতারা হয়ে গেল ব্রিটিশ-পাকিস্তানি কায়দার শাসক আর আমলারা হয়ে গেল ক্ষমতার মালিক। অনেকটা প্রভু আর দাসের মত। বুদ্ধিজীবীরা দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করে বুদ্ধিবৃত্তির জগতকে করেছে অপমানিত ও কলংকিত। স্বাধীনতার বিরোধী পাকিস্তান সরকারের বিশ্বস্ত আমলারা ১০ জানুয়ারির পরে হয়ে গেলো স্বাধীন বাংলাদেশের আমলা। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র সচিব হয়ে গেলো স্বাধীন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব। একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর যে ওসি বা এসপি মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করেছে, সেই ওসি বা এসপি স্বপদে সেখানেই বহাল রয়ে গেলো। আর বেকার হয়ে গেলো শিক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

এমনকি ওই আমলাদের কাছ থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের চারিত্রিক ও নাগরিক প্রত্যয়নপত্র বা সার্টিফিকেট নিতে হয়েছে। যে আমলারা তাদের প্রিয় পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারেনি সেই আমলাদের হাতেই তুলে দেয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের সচিবালয়। কী লজ্জা আর ঘৃণার বিষয়! এটা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে আনপ্রেডিক্টেবল ছিলো বলেই পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক হয়েছে। এসবের কারণ হচ্ছে, ভুল রাষ্ট্রনীতি, ভুল অর্থনীতি, ভুল শাসনব্যবস্থা। আমরা দেখতে পাই সেই পাকিস্তান-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আদলে যেভাবে, যে ভাষায় রাজনীতি করা হয়েছে, এখনো ঠিক সেভাবে, সেই ভাষায় রাজনীতি চলে আসছে।

এখনো স্বাধীন দেশ উপযোগী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ আইন, সমাজ কাঠামো, রাজনীতি এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকরূপ পায়নি। ঔপনিবেশিক আইন ও শাসনব্যবস্থার কারণে জনগণও পায়নি তাদের নাগরিক স্বাধীনতা, মৌলিক ও মানবাধিকার, ক্ষমতা, নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও অধিকার। স্বাধীনতা-উত্তর জাতির কাছে এটা ছিলো আনপ্রেডিক্টেবল। নেতাদের প্রতিশ্রুতি যখন আনপ্রেডিক্টেবল হয় তখনই পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক হয়ে যায়। স্বাধীনতার আগে রাজনীতিবিদের যেসব কমিটমেন্ট ছিল, স্বাধীনতার পরে তারা কি তা রক্ষা করেতে পেরেছে? না পারেনি।

প্রায় ৪৭ বছর পার হয়ে গেল। এখনো জাতি উপলব্ধি করতে পারলো না স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে। এখনো স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের স্লোগান জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দিচ্ছে। পাকিস্তানিদের মতো সেই সাম্প্রদায়িক ভাষায় বক্তৃতা করছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য, জিন্দাবাদ স্লোগান তো পাকিস্তানিদের ছিলো। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদরা কোন্ দেশের আদর্শ ধারণ করে? এই স্লোগানে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অস্তিত্ব আছে? কোন আর্দশের ভিত্তিতে কতিপয় রাজনৈতিক দল জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ না বলে পাকিস্তানি ভাষায় জিন্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছে? কী ঔদ্ধত্য এসব রাজনীতিবিদের।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসক নেই, আছে পাকিস্তানি আদর্শিক রাজনৈতিক দল। যাদের মুখে আছে স্বাধীনতার কথা, অন্তরে আছে পাকিস্তান। ভাবতে অবাক লাগে এরা নাকি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি করে! বর্তমান রাজনীতিক কর্মী ও নেতাদের মধ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ নেই। তাদের মধ্যে জনপ্রীতির বদলে ‘খাইখাই’ ভাবটা বেশি। এদের হিংস্র ছোবল সর্বত্র। এরা নিজ এলাকা খাবে, উপজেলা খাবে, জেলা শহর খাবে।

এরা বনখেকো, নদীখেকো, ভুমি-পাহাড়খেকো ও বিশ্বমানচিত্রখেকো। এদের মধ্যে রাজনীতিপ্রেম, গণতন্ত্রপ্রেম, জাতিপ্রেম, দেশপ্রেম, জনপ্রেম কিছুই নেই। এরা শৃংখলহীন, বাঁধনছাড়া, বীভৎস এক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দস্যু। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো এদের আদর দিয়ে লালন-পালন করছে। রাজনীতিক যখন দুর্বৃত্তায়ন ও দস্যুতার রূপ নেয় তখনই পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক হয়ে যায়।

গণতন্ত্র মানুষের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে বিকশিত করে এবং মুক্তচিন্তা ও মুক্তজ্ঞান চর্চার বাতায়ন খুলে দেয়। গণতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং শাসনব্যবস্থাপনার বৈচিত্র্যময় শৈলী গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে। সেই লব্ধ চেতনাকে শতভাগ ধারণ এবং বাস্তবায়ন করা বর্তমান রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছে কঠিন বলেই পলিটিক্স ইজ আনরোমান্টিক হয়ে যায়। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়