ডা. তাজুল ইসলাম : নাদিয়া, বয়স-১৭, দশম শ্রেণির ছাত্রী। সে একটু আহ্লাদী ধরনের। ফুপাতো ও খালাতো বোনদের কাছে ঘন ঘন যেতে চায়। পড়ালেখার চেয়ে হই-হুল্লোড় ও আড্ডা মেরে মজা পায় বেশি। তাই বাসা থেকে তাকে বাধা দেওয়া হয়। সে অল্পতেই রাগ-অভিমান করে, দরজা বন্ধ করে, না খেয়ে থাকে। অনেক সাধাসাধির পর অভিমান ভাঙে। ইদানীং পরিবার থেকে তার ওপর চাপ বেড়ে যায়। তার ভাই বলে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেবো, মা বলে ঘরের বাইরে আর যাওয়া যাবে না। ৮ দিন আগে হঠাৎ মাথা ঘুরে সে সেন্সলেস হয়ে পড়ে। তাকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয় ও পরদিন বাসায় ফিরে। আসার কয়েক ঘন্টা পরই আবার তার বুকে চাপ লাগে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আছে, কে যেন বুকে পাড়া দিচ্ছে- এভাবে আবারও সেন্সলেস হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফেরার পর বলে মাথা জ্বলছে, মাথা ব্যাথা করছে। এর কিছুক্ষণ পর চুপচাপ হয়ে যায়, চোখ দিয়ে পানি পড়ে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এরপর থেকে সে কয়েক ঘণ্টা পরপর ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মতন আচরণ করতে থাকে। যেসব ব্যক্তির রূপ তার মধ্যে দেখা দেয় সেগুলো হলো
খুশবো : এটি তার মূল চরিত্র (তার ডাক নাম)। কিন্তু অতি স্বল্প সময় সে এই আসল রূপে থাকে (১০-১৫ মিনিট)। এ সময় সে তার স্বাভাবিক যে আচরণ তা করে থাকে এবং অন্য ব্যক্তির রূপ গ্রহণ করে তা মনে করতে পারে না। দুই. আপন, এটি তার ছেলে রূপ। তখন সে সবাইকে তুই করে বলে (তুই বস, আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করবি না ইত্যাদি)। তখন সে ছেলেদের ভয়েসে কথা বলতে চেষ্টা করে ও আদেশ, উপদেশ দিয়ে থাকে। এই রূপ ৪-৫ ঘন্টা থাকে।
তিন. রিমঝিম : এটি তার নর্তকি ও দেবী রূপ। সে বিভিন্ন মন্দিরের কথা বলে, ত্রিশূলের মতন ভঙ্গি করে থাকে যেন শয়তান বধ করতে দেবী দাঁড়িয়ে আছে। সে তখন নাচে, গান গায়। এই রূপ ২-৩ ঘণ্টা থাকে। এ অবস্থা থেকে তার ভাই যদি বলে খুশবুকে এনে দাও সে তখন ওযু করে ও মুহূর্তে খুশবু হয়ে গিয়ে বলে ভাইয়া দেখো খুশবু এসেছে, খুব ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খেতে দাও।
চার. দুঃখ : এটিও স্বল্প সময় থাকে। এ সময় সে শুধু কাদতে থাকে। পাঁচ. সখিনা বিবি : এ সময় সে প্রেগন্যান্ট মহিলার মতন আচরণ করে, যার বাচ্চা তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি পেটে থাকতে মেরে ফেলছে। ছয়. বেবী (শিশু রূপ) : আমার চেম্বারে যখন তারা আছে তখন সে এই রূপ নিয়ে আছে। সে নাকি বেবী। শিশুদের মতন কথা বলে, চঞ্চলতা দেখায়। বলে আমি এবিসি শিখছি, অনেক নামতা পারি। আমাকে বলে তোমার বাসায় আমাকে নেবে?
এই বিভিন্ন ব্যক্তির রূপ ধারণ পর্যায়ক্রমে হতে থাকে। তার চিকিৎসার জন্য হুজুরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। হুজুর বলে জ্বীনের প্রভাব আছে এবং তিনি ওই জ্বীনকে বোতল বন্ধি করতে চান। কিন্তু জ্বীন বলে আমি আসবো না, আমি খুশবুর বোন। তার থেকে আমাকে আলাদা করলে খুশবুর ক্ষতি হবে। এরপর আরেক হুজুর জ্বীন বন্দি করে তবে বলে তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান, এর মানসিক রোগ হয়েছে। ওই হুজুরের কথায় তারা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে আমার চেম্বারে আসে। এই কেস হিস্ট্রি থেকে কী শিখলাম? হিস্ট্রিয়নিক পার্সোনালিটি যাদের তাদের এরকম রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে (খুশবুর মধ্যে এর অনেক লক্ষণ রয়েছে)। দুই. অপরিপক্ব ব্যক্তিত্ব যাদের তারাও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ (বয়স অনুপাতে ও খুশবু অনেক অপরিণত)। তিন. তথাকথিত জ্বীন-ভূতে ধরা রোগী সবাই মানসিক/ব্রেইনের রোগী। ইদানীং জ্বীন তাড়ানো হুজুরাও তা বুঝতে শিখেছে। তাই তারা চিকিৎসার নামে জ্বীন তাড়িয়েও বলে, জ্বীন তাড়িয়ে দিয়েছি, সব ঠিক হয়ে গেছে তবে একটু বাকি আছে সেটি মানসিক ডাক্তারকে দেখান। চার. এ কারণে বর্তমানে আমরা অনেক এরকম রোগী পাচ্ছি যাদেরকে হুজুররা আমাদের কাছে রেফার করে থাকেন। পাঁচ. পরিবার বা অন্যরা ওই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে বেশি মনোযোগ বা যত্ন দিয়ে থাকে যা ওই রোগকে দীর্ঘায়িত করে। একে আমরা বলি সেকেন্ডারি গেইন বা সোশ্যাল রি-ইনফোর্সমেন্ট। অসুস্থ আচরণকে ইগনোর করে, সুস্থ আচরণকে পুরস্কৃত করতে হবে- তাহলেই রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। ছয়. মানসিক দ্বন্দ্ব বা চাপের যে কষ্ট, অস্বস্তি সেটি থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে ব্রেইন এ ধরনের অবস্থা তৈরি করে। সাত. এগুলো রোগীরা ইচ্ছে করে তৈরি করে না। তাই তাদের কোনো রোগ নেই, বানিয়ে বানিয়ে করছে ভাবা অন্যায় হবে। আট. এই রোগের নাম মাল্টিপল পারসনালিটি ডিসঅর্ডার, যা ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার এর একটি রূপ।
লেখক : অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট