বিভুরঞ্জন সরকার : ছোট পাত্র চুলায় গরম হয় তাড়াতাড়ি। ভাতের হাঁড়ির পানির চেয়ে চায়ের কেটলির পানিতে আগে বলক আসে বা ফোটে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পরও দেখা যাচ্ছে ছোট দলের বড় নেতা কিংবা দলহীন ব্যক্তিরা একটু ফটফট বেশি করছেন। যাদের পেছনে মানুষ কম তারাই বড় বড় কথা বেশি বলছেন, ছটফটানিও তাদেরই বেশি। গরম তেলে ফোড়ন দেওয়ার মতো তারা টগবগ করে ফুটছেন। বড় দলের বড় নেতারা মুখ সামলে চললেও ছোট দলের বড় নেতারা নিজেদের সামাল দিতে পারছেন না। বড় জনসভা দেখে তাদের মাথা গরম হয়ে উঠছে। সিলেটের পর চট্টগ্রামে গিয়েই বেসামাল অবস্থা। মনে হচ্ছে নির্বাচনের আগেই তারা ক্ষমতায় বসে গেছেন।
ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামে বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য একটাই, সরকারের পতন। — গদি না ছাড়লে কীভাবে ছাড়াতে হয় সেটা আমাদের জানা আছে।’
মাহমুদুর রহমান মান্না জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন, সেটা জানা থাকলেও তিনি কোন সরকারকে গদিছাড়া করেছেন, সেটা জানা নেই। তিনি যদি তার এই অভিজ্ঞতার কথাটা একটু জানাতেন তাহলে সবারই উপকার হতো। ভবিষ্যতেও কাউকে গদিছাড়া করার দরকার হলে মান্নাকে ‘ভাড়া’ করা যেতো।
প্রসঙ্গত, ছোটবেলায় শোনা একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। এক ঘোড়সওয়ার পথের ধারের চায়ের দোকানে চা খেতে বসেন ঘোড়াটিকে পাশে রেখে। হঠাৎ এক দুষ্টু বালক ঘোড়ায় চড়ে দে চম্পট। চা পান শেষে ঘোড়ার মালিক ঘোড়া না পেয়ে দোকানির ওপর চোটপাট শুরু করলেন। তাড়াতাড়ি ঘোড়া ফেরত না পেলে ভয়াবহ কা- ঘটিয়ে ফেলবেন। হুমকি দিয়ে বললেন, আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনবো, এরমধ্যে ঘোড়া না পেলে চট্টগ্রামে যা করেছি তাই করবো। তার চোটপাটে কিছু কৌতূহলী মানুষও জুটে গেল। এক থেকে আট পর্যন্ত গোনার আগেই ছেলেটি ঘোড়া ছুটিয়ে কীভাবে যেন চলেও এলো। ঘোড়া ফেরত পেয়ে ভদ্রলোক খুশি। তখন চায়ের দোকানি আস্তে করে জানতে চাইলো, ভাই চট্টগ্রামে আপনি ঠিক কী করেছিলেন?
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, চট্টগ্রামে ওরা আমার ঘোড়া নিয়ে ফেরত না দেওয়ায় আমি মনের দুঃখে পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরেছিলাম।
মান্নার গদিছাড়া করার হুমকি কি অনেকটা সেরকম নয়? তিনি নিজে একাধিক দল ছেড়েছেন, কাউকে গদিছাড়া করেছেন, তার কোনো প্রমাণ কি কেউ দিতে পারবেন?
গণফোরামের কামাল হোসেনও ঐক্যফ্রন্টে গিয়ে গরম হয়ে উঠেছেন। চট্টগ্রামের সমাবেশে কামাল হোসেন বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া না হলে প্রতি ঘণ্টার জন্য সরকারকে শাস্তি পেতে হবে।
আইনের লোকের এ কী বেআইনি কথা! খালেদা জিয়া জেলে আছেন আদালতের নির্দেশে। তার মুক্তির জন্য কামাল হোসেন আইনি সহায়তায় এগিয়ে না এসে সরকারকে হুমকি দিচ্ছেন। তিনি এটাও বলেছেন যে, ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা না মানলে নাকি সরকার যে শাস্তি পাবে তা তারা কল্পনা করতে পারবে না।
কোন আইনে, কোন ধারায় এমন গুরুদ-ের বিধান আছে, সেটা যদি সেটা যদি আইনবিশারদ ড. কামাল একটু খোলাসা করে বলতেন, তা হলে আমাদের মতো ম্যাঙ্গোপিপল বা আমজনতার সুবিধা হতো।
চট্টগ্রামে ঐক্যফ্রন্টের সভায় সবচেয়ে উদ্দীপক কথা বলেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘‘১০ দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে। এ সময়ের মধ্যে দেশের সব বুদ্ধিজীবী ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেবেন। বামপন্থি, আওয়ামীপন্থি সব বুদ্ধিজীবী আসবেন। শুধু ১০ দিন অপেক্ষা করুন, দেখুন কী হয়।’’
কী হয় সেটা দেখার জন্য আমার মতো আরো অনেকেরই নিশ্চয়ই তর সইছে না। আমি তো রীতিমতো রোমাঞ্চ অনুভব করছি। সেই কবে জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ পড়ে বুকে বিপ্লবের স্পন্দন অনুভব করেছিলাম। বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয়েছিলো, আমিই লেনিন। সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবের ঝড়ো দশ দিনের কাহিনি আমাদের কৈশোর- যৌবন মাতিয়ে রেখেছিলো। দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনের বিপ্লব দুনিয়ায় তৈরি করেছিলো বিরাট তোলপাড়। তারপর গত শতকের নব্বই দশকে সেই বিপ্লবের পরিণতি ‘ধপাস ধরনী তল’।
এতোদিন পর, লেনিনের পর বাংলাদেশে ডা. জাফরুল্লাহ নামের এক ভয়াবহ রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী আমাদের সামনে বিছিয়ে দিলেন দশ দিনের স্বপ্নজাল। দশ দিনেই দেশে ঘটে যাবে পরিবর্তন। সব বুদ্ধিজীবী যোগ দেবেন ঐক্যফ্রন্টে! জুয়েল আইচের জাদু নয় তো!
জাফরুল্লাহ চৌধুরী কয়েকদিন আগে সেনাপ্রধান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্বীকার করছিলেন যে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে কখনো কখনো তার স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা সঠিকভাবে কাজ করে না।
চট্টগ্রামে ভাষণ দেওয়ার সময় কি তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ছিলেন?
ডা. জাফরুল্লাহর বক্তৃতা শুনে মনে পড়ছে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের ৩০ এপ্রিল ট্রাম্প কার্ডের কথা। ৩০ এপ্রিল কী ঘটবে তা নিয়ে সে কি উত্তেজনা! ডা. জাফরুল্লাহর ‘দশ দিন’ কি তেমন কিছু? ২৭ অক্টোবর থেকে সময় গননা শুরু করলে ৫ নভেম্বর হবে দশ দিন। রুশ বিপ্লবের দশ দিন ছিলো ৬ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ।
আমাদের দেশ কাঁপানো দশ দিনের জন্য ডা. জাফরুল্লাহ এবং তার সঙ্গীসাথীরা কার সঙ্গে কী কী পরিকল্পনা করেছেন তা এখন খুঁজে বের করা দরকার নয় কি? মানুষ যাতে বিপন্ন বোধ না করে সেটা দেখার দায়িত্ব তো সরকারের। নয় কি? সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব