সমকাল : সমকাল ও এডিডির আয়োজনে বুধবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ - সমকাল
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কার দূর করতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করতে না পারলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। এটি অন্যান্য রোগ-ব্যাধির মতোই একটি সমস্যা। চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিরাময়যোগ্য। মানসিক রোগ কোনো জিন-ভূতের আছর লাগার বিষয় নয়। সমাজে এ নিয়ে যেসব কুসংস্কার রয়েছে, তার সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই।
'মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও স্টিগমাসমূহ' শীর্ষক এক গোলটেবিলে বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল সকালে রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে সমকাল ও এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। নির্ধারিত বিষয়ে আলোচনা করেন এডিডি ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর শফিকুল ইসলাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (এনসিডি) ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার (সিসিএইচসি, ডিজিএইচএস) ডা. তানভীর আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল বিভাগের শিক্ষক কামাল আহমেদ চৌধুরী, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ, স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডা. নওজিয়া ইয়াসমিন, সিআরপির নির্বাহী পরিচালক শফিক উল ইসলাম, সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন বাংলাদেশের (সিডিডি) নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান, ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের (আইডব্লিউএফ) নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান, আইসিডিডিআরবি'র ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ ডিভিশনের রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর শামীমা সিরাজী, অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার-এসিএফের মুক্তা জাহান বানু, ব্র্যাকের উত্তম কুমার সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাসিনা মমতাজ। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন
এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রজেক্ট ম্যানেজার নাজমুন নাহার।
মুস্তাফিজ শফি বলেন, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষের চিকিৎসা যেমন জরুরি, তেমনি এ সমস্যার পেছনের কারণও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। অনেক সময় অর্থনৈতিক কারণেও কাউকে কাউকে মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলা হয়। কারণ, এটা করা গেলে আইনগতভাবে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়। তিনি বলেন, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষ বেশিরভাগ সময়ই স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পারিবারিক, সামাজিক বা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকেও তারা পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
শফিকুল ইসলাম বলেন, মানসিক রোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা জরুরি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের কোনো সদস্য মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে অন্যরা তা গোপন করার চেষ্টা করেন। অথচ পরিবারের সহানুভূতি এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। দীর্ঘদিন মানসিক রোগে আক্রান্তদের পাশে থেকে সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন এ বিষয়ে অনেকের মধ্যেই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হচ্ছে। অনেকে নিজে থেকেই মানসিক রোগ নিয়ে কথা বলছেন। তিনি বলেন, মানসিক রোগ নিয়ে রাখঢাক না করে এ নিয়ে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় জরুরি। সবার মধ্যে এর মেসেজ পৌঁছে দিতে হবে- পারিবারিক সমর্থনই পারে মানসিক রোগে আক্রান্তদের দ্রুত সুস্থ করে তুলতে।
বৈঠকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নিজের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন কামাল আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, শিক্ষিত অনেক মানুষও বিশ্বাস করেন, জিনের আছর লাগার কারণেই মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করেন। এ বিশ্বাস থেকে কাউকে ফিরিয়ে আনার চেয়ে কঠিন কাজ নেই। তিনি বলেন, কুসংস্কার দূর করতে না পারলে মানসিক রোগ নিরাময় কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তবে এটাও সত্যি, এ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যাবে না। এর জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রোগ শনাক্ত করে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না করতে পারলে ৩০ বছর পরও একই পরিস্থিতি থেকে যাবে।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানসিক ভারসাম্য হারানো ব্যক্তিকে পরিবার, সমাজের মানুষ নানাভাবে ব্যাখ্যা করে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চবিত্ত পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষের মনে এ নিয়ে নানা কুসংস্কার রয়েছে। আর এ কুসংস্কার থেকেই চিকিৎসার নামে তাদের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। শিকল দিয়ে বেঁধে ঘরে আটকে রেখে তাদের পরিবার বিচ্ছিন্ন করা হয়। পরিবার ও সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করতে না পারলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অনেকটাই অসম্ভব। এসব চিকিৎসায় জড়িত ওঝা-কবিরাজদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমেও সমাজে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সেলিনা আহমেদ বলেন, সামাজিকভাবে মানসিক রোগ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করতে হবে। অনেকে জানেনই না, মানসিক সমস্যা এক ধরনের রোগ। অনেক ক্ষেত্রে রোগ চিহ্নিত হলেও রোগীকে 'হ্যারেসমেন্ট'-এর শিকার হতে হয়। এ পরিস্থিতি এড়াতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মনিরা রহমান বলেন, 'ব্রোকেন হার্ট' নিয়ে সমাজে কথা বলা হয় না। মানসিক সমস্যা সৃষ্টির এটাও অন্যতম কারণ। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়বে না- এ কথা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না। তাই এ রোগ প্রতিরোধে আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করতে হবে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি চারজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। দীর্ঘমেয়াদি এ সমস্যা একসময় প্রকট আকার ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকে যেভাবে 'জেনারেল হেলথ সার্ভিস' বিভাগে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও আলাদা বিভাগ রাখা জরুরি। যেন স্বাচ্ছন্দ্যে রোগীরা তাদের সমস্যা বলতে পারেন, চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে।
ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের ধারণা পরিস্কার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন এনজিও তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে চলেছে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এ রোগকে কীভাবে দেখা হয়, তাও বের করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নিচ্ছে সেবা সংস্থাগুলো। তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানে যে নীতিমালা রয়েছে, তাতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিও যুক্ত করতে হবে।
শামীমা সিরাজী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রোভাইডারের মাধ্যমে মনোসামাজিক উদ্দীপনার ওপর প্রশিক্ষণ করাতে হবে। বিশেষ করে মায়েদের এক বছর ধরে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হলে তার শিশুকে খেলার ছলে শেখানো যাবে।
অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা মানসিক সমস্যাকে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তারা বলেন, মানসিক সমস্যা একদিনে তৈরি হয় না। এটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং একটা সময় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। তাই একজন মানুষের মধ্যে যখন মানসিক সমস্যার উপসর্গ দেখা দেয়, তখনই এর সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।