ডেস্ক রিপোর্ট : ম্যারির (প্রকৃত নাম নয়) বয়স তখন ১৬, যখন সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। তাঞ্জানিয়ার উত্তরাঞ্চলে ওর বাড়ি। ওই সন্তানের বাবা বাড়ির কাছেই রাস্তায় চিপস বিক্রি করত। ম্যারিকে টাকাপয়সা দেয় সে। আর ম্যারির এতে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। কিন্তু ওর পেট যখন ক্রমে বড় হতে শুরু করে, কেটে পড়ে লোকটা। স্কুলে শিক্ষক, কুঁকড়ে যাওয়া মা-বাবার সামনে বেতপেটা করা হয় ম্যারিকে। তাড়িয়ে দেওয়া হলো স্কুল থেকে। ‘যদি জানতাম একবার মিশলেই অন্তঃসত্ত্বা হতে পারি,’ ও বলে, ‘কখনো এ কাজ করতাম না।’
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাঞ্জানিয়ার ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বালিকাদের এক-চতুর্থাংশই অন্তঃসত্ত্বা কিংবা মা হয়েছে। সরকার এর জবাব দিয়েছে ওদের স্কুল থেকে জন্মের মতো তাড়িয়ে দিয়ে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ৫৫ হাজারের বেশি মেয়েকে স্কুল ছাড়তে হয়েছে। সন্দেহ নেই, সংখ্যাটা অনেক কম। প্রায়ই ঘটনাগুলোকে স্কুলপালানো হিসেবে দেখানো হয়। লেখাপড়ায় ফেরার প্রধান রাস্তা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কিংবা টিউশনি ফি দিতে হয় এমন স্কুল, যার খরচ বেশির ভাগই বহন করতে পারে না। নীতিটি আরও জোরদার করা হয়েছে বাধ্যতামূলক গর্ভপরীক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষকেরা মেয়েদের ক্লাস থেকে বাইরে নিয়ে যান তাদের প্রস্রাবের নমুনা সংগ্রহ করতে অথবা প্রায়ই পেটে চাপ বা গুঁতো দিতে।
আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে এর কোনটিরই প্রয়োজন নেই। তবে অস্পষ্ট আইন অনুযায়ী ‘নৈতিকতাবিরোধী অপরাধের’ জন্য একজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সুরে কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের স্কুলে ফিরে আসার জন্য একটি খসড়া নির্দেশিকা উপস্থাপন করেছে। ক্ষমতাসীন দলের ইশতেহারে বলা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে।
এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির মনোভাব স্পষ্ট। গত বছর তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তোমরা শেষ।’ আইনপ্রণেতা হালিমা মডি প্রেসিডেন্ট মাগুফুলির এই অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেন। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্টকে অসম্মান করার অভিযোগ আনা হয়।
অতীতে, একজন শিক্ষক বলেন, সহানুভূতিশীল স্কুলগুলো সন্তান জন্মদানের পর মেয়েটিকে আবার ভর্তি করে নিত। কিন্তু এখন আর সে সাহস দেখায় না। আঞ্চলিক এক কর্মকর্তা ‘অন্যদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য’ কোনো স্কুলছাত্রী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তাকে গ্রেপ্তার করার আহ্বান জানিয়েছেন। পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শাস্তি দিয়ে কিশোর বয়সের গর্ভধারণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। দেশটিতে মেয়েদের অন্তঃসত্ত্বার হার প্রতিবেশী দেশ কেনিয়ার চেয়ে বেশি। অথচ সে দেশে মায়েদের ক্লাসে ফেরার অনুমোদন রয়েছে। দেখা গেছে, গরিব ও গ্রামাঞ্চলে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। সেখানে গর্ভনিরোধক দ্রব্য পাওয়া যায় না এবং ভালো গ্রেড পাইয়ে দেওয়া কিংবা মোটরবাইকে চড়িয়ে স্কুলে নেওয়ার বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়ে থাকে। সরকারি এক জরিপে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের শতকরা ১১ ভাগই কোনো না কোনোভাবে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। একজন সমাজকর্মী ১৪ বছর বয়সে কীভাবে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, সে কথা স্মৃতিচারণা করে বলেন, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার জন্য ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি দোষারোপ করা হয়ে থাকে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাঞ্জানিয়ার এই মনোভাব অস্বাভাবিক হলেও অনন্য নয়। সিয়েরা লিওন ও ইকুয়েটোরিয়াল গিনিতেও অন্তঃসত্ত্বা হওয়া ছাত্রীদের বহিষ্কার করা হয়। আফ্রিকার অন্যান্য দেশে আইনের ব্যাপক হেরফের আছে। মালাওয়িতে অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের ১২ মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়। পরে কিছু কাগজপত্র পূরণ ও স্বাক্ষরের পর পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে ফিরে আসার অনুমোদন দেওয়া হয়। সেনেগালে সুস্থ বলে সার্টিফিকেট নিয়ে এলে আবার ভর্তি নেওয়া হয়। রুয়ান্ডা, গ্যাবনসহ বেশ কিছু দেশে মায়েদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ উৎসাহ দেওয়া হয়। ২৪টি দেশে স্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। সেখানে স্থানীয় কর্মকর্তাদের ইচ্ছার ওপর মেয়েদের ভাগ্য নির্ভর করে।
অনেক মেয়ের জন্যই অন্তঃসত্ত্বা হওয়া মানে তাদের স্বপ্নের অবসান। কেউ কেউ গর্ভপাত ঘটানোর ঝুঁকি পর্যন্ত নেয়। অন্যরা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অনেকে আবার পরিচারিকার কাজ করতে বাধ্য হয়। কিছু মেয়ে যৌনকর্মীর কাজে জড়িয়ে পড়ে। ম্যারি এখন জীবিকার তাগিদে অন্যের বাড়িতে থালাবাসন ও হাঁড়িপাতিল ধোয়া-মোছার কাজ করছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে সে বলছে, ‘আমি সুযোগ পেলে আবার স্কুলে যাব।’
সূত্র : প্রথম আলো
আপনার মতামত লিখুন :