মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ: ইসলামের ইতিহাসে মহাবীর খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ছিলেন আরবের প্রখ্যাত কুরাইশ বংশের সম্ভ্রান্ত শাখা বনী মখজুমের কৃতি সন্তান। তিনি উম্মত-জননী হজরত মায়মুনা (রা.)- এর নিকটাত্মীয় ছিলেন। ৫ হিজরির শেষ ভাগে মদিনায় হাজির হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। খালিদ ইবনে ওয়ালিদের রক্তে বংশগতভাবেই সংগ্রামী তেজস্বিতা বিদ্যমান ছিলো। সে কারণেই তিনি ইসলামে দীতি হবার আগেই ঐ সময়ের অপরাজেয় বীর যুদ্ধা ছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহৎ যুদ্ধ ওহুদে তিনিই মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ইসলামের পক্ষে অনেকগুলি যুদ্ধের ভেতর সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ছিলো মুতার যুদ্ধ। আরব সীমান্তের বাইরে এটি ছিলো সর্বাপোরি ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্ববহ অভিযান। এতে হজরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.), হজরত জাফর তাইয়াব (রা.), এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) এই তিনজন সেনাপতি একেরপর এক শহিদ হন। এরপর হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) সেনাপতির গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে হতাশাগ্রস্ত মুসলিম বাহিনীকে সমূহ বিপর্যয়ের হাত থেকে সম্মানজনকভাবে সরিয়ে আনতে সম হন। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই মুসলিম বাহিনীর বহির্জগতে অগ্রাভিযানের সূচনা হয়। হজরত খালিদ (রা.)- এর এই কৃতিত্বে প্রিয়নবী (সা.) অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ বা আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে তায়েফ, হুনাইন, তাবুক ও ইয়ামান অভিযান প্রধানত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) এর নেতৃত্বেই সুসম্পন্ন হয়।
মহানবী (সা.) এর ইন্তেকালের পর প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এর খেলাফতকাল শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে একাধিক ভ- নবীর আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে দুর্ধর্ষ এক গোত্রের সর্দার ছিলো তোলায়হা। তাকে দমন করার লক্ষ্যে হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) কে প্রেরণ করা হয়। তোলায়হার বাহিনী ছিলো খুবই দুর্ধর্ষ এবং ভয়ংকর প্রকৃতির। খালিদ (রা.) এদের পরিপূর্ণ উৎখাত করে নবুওয়তের সর্বাপো বড় মিথ্যা দাবিদার মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে প্রেরিত বাহিনীর সঙ্গে শরীক হন। পথিমধ্যে আর এক ভ-নবী মোজায়নাকেও গ্রেফতার করে মদিনায় নিয়ে আসেন। ভ- নবুওতের দাবীদারদের পাশাপাশি মুরতাদ-বিদ্রোহীদের দমনে হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) পরিচালিত সকল অভিযান সফল হয়।
আরব উপদ্বীপটি ছিলো বহুকাল ধরেই তদানীন্তন পৃথিবীর দুটি পরাশক্তির প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন। একদিকে ইরাক পারস্য সা¤্রাজ্যের অধীনে এবং ইয়ামান করদ শাসকের অধীনে। অপরদিকে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন ছিলো রোমক সা¤্রাজ্যের অধীন। এই দুটি আগ্রাসী পরাশক্তির প্রভাব বলয় থেকে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি খেলাফতের নিরাপদ বিকাশ নিশ্চিত করতে রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে যে প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই দুঃসাহসী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই হজরত আবু বকর (রা.) ‘আল্লাহর অসি’ খেতাবপ্রাপ্ত মহাবীর হজরত খালিদ (রা.) এর নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করেন। হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) অত্যন্ত চমকপ্রদভাবে একের পর এক বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিশাল শত্রুবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ইরাক জয় করেন। এক পর্যায়ে ইরানি ও রোমক শক্তির সম্মিলিত বাহিনীর সম্মুখীন হয়েও খালিদ (রা.) এর অগ্রগতি অব্যাহত থাকে।
বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় হজরত খালিদ (রা.) এর তাৎপর্যপূর্ণ কৃতিত্বসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি। এক কথায়, হজরত খালিদ (রা.)- রর হাতের ঝলকিত আল্লাহর অসিই মূলত: যুগপৎভাবে রোম ও পারস্য সা¤্রাজ্যের মেরুদ- ভেঙ্গে দিয়েছিলো। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহিণের পর হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) মদিনায় চলে আসেন। কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ২২ হিজরি সনে ইসলামি ইতিহাসের এই মহাবীর ইন্তেকাল করেন।