বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মহীরুহ তিনি। সাংবাদিকদের সাংবাদিক। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সব সময় সমসময়ের প্রতিনিধি। তাই যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন তাঁর পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে। মুখর পেশাজীবনে তাঁর পথচলা অন্তবিহীন। ব্যক্তিজীবনে স্মার্ট আর স্টাইলিশ। তাঁর লেখনীও তেমন নির্মেদ আর তীক্ষ। যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। আপাতগম্ভীর এই মানুষটির সাহচর্য যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা জানেন, ওই গাম্ভীর্যের খোলস খুলে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে একজন তোয়াব খানকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তাঁর জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরির্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তাঁরই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। সব সময় পাঠকই তাঁর ‘প্রাইমারি কনসার্ন’। সংবাদপত্রে পুরো পাতা ফ্যাশন আর টেকনোলজির জন্য বরাদ্দের কথা তাঁর আগে আর কে-ই বা ভেবেছে! দৈনিক জনকণ্ঠে তিনি সেটাই করেছেন। পাঠককে দিয়েছেন নতুন স্বাদ। এটা একদিকে যেমন পাঠকদের কথা মাথায় রেখে, তেমনি সময়ের দাবি মেনে। সাংবাদিকদের সম্পর্কে পুরনো ধ্যানধারণাও তিনি বদলে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান বলতে যা বোঝায়, তার শেষ সলতে তোয়াব খান সাংবাদিকতায় গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য ২০১৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। একই বছর বাংলা একাডেমি তাঁকে বরণ করে নেয় সম্মানিক ফেলো হিসেবে।
১৯৫৩ সালে কে জি মুস্তাফার সঙ্গে সাপ্তাহিক জনতার মধ্য দিয়ে হাতেখড়ি হয়ে যায় সাংবাদিকতাজীবনের। ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন সংবাদে। রণেশ দাশগুপ্ত, সৈয়দ সাবের, শহীদুল্লা কায়সার, সত্যেন সেন, জহুর হোসেন চৌধুরীরা কাজ করেছেন এই পত্রিকায়।
১৯৫৫ সালে শুরু করে তোয়াব খান ১৯৬১ সালে বার্তা সম্পাদক হন সংবাদের। এ পদে ১৯৬৪ পর্যন্ত থেকে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। বার্তা সম্পাদক হিসেবেই। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ওই সময় বাংলাদেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নানা বিচ্যুতি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে কলাম লেখায়। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামে বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব। আর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রেসসচিব। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক। তাঁর তীক্ষ লেখনী আর আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় নিয়মিত প্রচারিত হয়েছে ‘পিন্ডির প্রলাপ’।
তোয়াব খান নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র যে মানুষটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাঁকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। আপাতগাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস, তাঁকে আবিষ্কার করা সহজ নয়। এর জন্য সময় ও শ্রম দিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তোয়াব খান নিজে কয়জনের কাছে উন্মোচিত করেছেন নিজেকে? গুরুগম্ভীর তোয়াব খানের আড়ালে যে স্নেহময় মানুষটি লুকিয়ে, তাঁকে কি তিনি প্রকাশ করেছেন সবার সামনে?
অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। তিনি শুধুই একজন সাংবাদিক নন, বরং সাংবাদিকদেরই সাংবাদিক। পেশাগত জীবনে ছয় দশক পেরিয়ে নিঃসন্দেহে তিনি আজ এক প্রতিষ্ঠান। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই এখনো চলছে, সে লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোয়াব খান। আজ তাঁর জন্মদিন। দীর্ঘায়ু হোন তিনি।