নিজস্ব প্রতিবেদক : শহীদনগর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন ১৪ নম্বর গলির ৫ নম্বর দোকান অনেকের জন্য শরবতের দোকান হলেও এলাকার বেশির ভাগ গরিব মানুষের জন্য এটি কম টাকায় ওষুধের কবিরাজখানা! ৬২ রকমের গাছগাছালির গুঁড়া মসলা দিয়ে তৈরি করা শরবত খেতে সকাল ৬টা থেকে ভিড় জমায় মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক মানুষ। এভাবে চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। এলাকার অনেকের কাছে এটি সালাম ভাইয়ের শরবত আর কারো কাছে কবিরাজ সালাম সরদারের কবিরাজখানা।
দোকানটিতে শুক্রবার গিয়ে দেখা যায়, একটি টেবিলে অনেকগুলো কাচের আর প্লাস্টিকের বোতল সামনে নিয়ে বসে আছেন সালাম নামের গরিবের ডাক্তার। আর একটু পর পর কেউ এসে বলছে, এক গ্লাস শরবত দেন। ক্রেতার চাওয়ামাত্র প্রায় সবগুলো বোতলের মুখ খুলে একটু একটু করে মসলা দিয়ে যত্নের সঙ্গে শরবত বানিয়ে দিচ্ছেন। সকাল ১০টার এই চিত্র এমন হলেও সন্ধ্যার পরপর ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে তার সঙ্গে যুক্ত হয় তার বড় ছেলে সোহাগ। শনিবার সকাল ৬টায় দেখা যায় স্বাস্থ্যসচেতন বেশ কিছু মানুষ হাঁটতে বের হয়ে এই শরবত খেতে চলে এসেছেন। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন আফরোজা হাসি। বয়স খুব বেশি না হলেও বেশ স্বাস্থ্যসচেতন এই শিক্ষিকা বলেন, ‘আমি এখানে প্রায় সময়ই আসি। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করলেও গাছ কখনো করে না। তাই এখানে এসে এই শরবত খাই। ২০ টাকা নিলেও খাওয়ার পর শরীরে একটা প্রশান্তি অনুভব হয়।
আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, উলটকম্বল, বেল, হালিম দানা, আর্জুনের ছাল, শিমুলের মূল, যষ্টিমধু, কালিজিরা, লাচ্ছা, লং পাউডার, তেঁতুলের বিচি, অশ্বগন্ধা, চিরতা, অ্যালোবেরাসহ প্রায় ৬২ রকমের ওষধি ও বনাজি গাছের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা এই শরবত বিক্রি হয় মাত্র ১০ টাকায়। এ ছাড়া ২০ টাকা, ৩০ টাকাসহ বিভিন্ন দামেও পাওয়া যায়। তবে গরিবের জন্য ১০ টাকাই নেন এই দোকানি। এই গলির শরবত কাজ করছে নানা ধরনের রোগ নিরাময়ে। এর মধ্যে রয়েছে—হাত-পা জ্বালাপোড়া, প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া, মুখের মেসতা দূর, চোখের উপকার, ব্রণ দূর হওয়াসহ বেশ কিছু কঠিন রোগ। ‘উপকার হয় বলেই আসি, এহন মানুষ মনে করে, যত বেশি টাকা খরচা, তত বেশি ভালো চিকিৎসা! এটা ঠিক না, গাছগাছালির ওপর কিছু হয় না।’ এমনভাবেই বলছিলেন আরেক ক্রেতা মাহতাব হোসেন। পেশায় রিকশাচালক হলেও তাঁর নির্দেশনামূলক কথা শুনে অনেকেই হতবাক। শহীদনগরের এই এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, এখানে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। সকালে বের হয়, সারা দিন কাজ করে রাতে ফিরে। পেট ঠাণ্ডা করার জন্য অনেকেই এই শরবত খায়। আর খায় এই বিশ্বাসে যে শক্তি পাব। বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ করেন কাজলরেখা। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। দোকানে এলে প্রতিদিনই এই শরবত খান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, মাঝেমধ্যে হাত-পা জ্বালাপোড়া করে, তখন এসে এক গ্লাস খাই। জ্বালাপোড়া পুরো না গেলেও কিছুটা কমে।’
অনেকের কাছে কবিরাজ বনে যাওয়া মো. সালাম সরদার বলেন, ‘আমি অর্ধযুগেরও বেশি সময় এখানে আছি। শরবত বিক্রি করে আমার কোনো উন্নতি না হলেও অনেক মানুষ খেয়ে শান্তি পায়। এতে আমিও শান্তি পাই। আর পরিবার নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার মতো টাকাও হয়ে যায়। আমি বড় হতে চাই না, ধনী হতে চাই না। এভাবে থাকলেই চলবে। আপনি দেখেন, আমার এই জায়গায় কোনো কবিরাজি দাওয়াখানা বা শরবতের দোকান—কোনো কিছুরই নামফলক নাই। কারণ আমি প্রচার চাই না, ভাই।’
কবিরাজের এই দাওয়াখানা চালাতে সহায়তা করেন তাঁর ছেলে সোহাগ। সোহাগ খুব বেশি পড়াশোনা না করলেও বাবার মতো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন তার মধ্যেও বাসা বেঁধেছে। তাই দোকানেই বেশির ভাগ সময় বসে থাকে। সোহাগ বলে, ‘ভোরের দিকে একটু চাপ বেশি থাকে। তখন মানুষ বেশি আসে। প্রতিদিন কয়েক শ গ্লাস শরবত বিক্রি করি আমরা। কখনো কম, কখনো বেশি। সারা দিন খুব একটা চাপ থাকে না। তবে সন্ধ্যার পর আবারও ক্রেতা আসতে শুরু করে। অনেকে বাসায় নিয়েও খায়। কেউ গাছের গুঁড়া নিয়ে যায়।’ সূত্র : কালের কণ্ঠ
আপনার মতামত লিখুন :