কাকন রেজা : নারী দিবসে নারী নিগ্রহের বিপক্ষে বিভিন্নজনের ‘স্ট্যাটাস’ এবং লেখা দেখলাম যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে। এক ‘স্ট্যাটাসে’র বিপরীতে নিগ্রহের পক্ষে অজুহাত দিতে গিয়ে একজন বললেন, ‘হজ্বেও তো নারী নিগ্রহ হয়’। ভালো অজুহাত। এক্ষেত্রে ধর্ম বিষয়টি মন্দ না, কাজে অকাজে তার আশ্রয় নেয়া যায়। কল্যাণ-অকল্যাণ, যুদ্ধ-রাজনীতি সবকিছুতেই ধর্ম অনুষঙ্গ দাঁড়ায়।
সারা পৃথিবী, আমাদের এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া আরো ছোট করলে আমাদের দেশ সবখানেই ‘অজুহাত’ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্ম। একপক্ষ আরেক পক্ষকে নিধনযজ্ঞে নেমেছে ধর্মের ‘অজুহাতে’। এই ‘অজুহাতে’র পরিণতি কিন্তু একটাই, মৃত্যু আর ধ্বংস। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, গুজরাট, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক, মিয়ানমার, হালের শ্রীলংকা সবখানেই জান-মাল হারাচ্ছে মানুষই।
হত্যার নৃশংসতার সাথে ধর্ষণের মতন ঘৃণ্য কাজও হয়েছে ধর্মগুলোর নামে।
একই মানসিকতায় নারী নিগ্রহের ব্যাপারটিকে বৈধ করতে ধর্মকে ঢাল করছেন অজ্ঞেয়বাদের অনেক দাবীদাররা। সামনে আনছেন ‘হজ্বেও নারী নিগ্রহ হয়’ এমন মন্দ বক্তব্যকে। তবে কী এর আড়ালে ‘নারী নিগ্রহ’কে বৈধ করার চেষ্টা করছেন তারা! ভেবে দেখুন এখানে ধর্ম অনুষঙ্গ মাত্র, অজুহাতের অনুষঙ্গ। যার দুপার্শ্বে হুংকাররত কিছু ক্রুর মানুষ, দুটি এক্সট্রিমিস্ট গোষ্ঠী।
এর কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেক কিছুই খোঁজ করতে হয়, দৃশ্যত অনেক সাদামনেও কাদার সন্ধান পাওয়া যায়। অতদূর যাবার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু ভেবে নিলেই চলবে, পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ কী সব ধর্ম নিয়েই হয়েছিল,না কী অন্য অনুষঙ্গও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র-বৃটেনে সাদা-কালোয় দাঙ্গা হয়, যাকে বলা হয় বর্ণবাদ। আফ্রিকায় হয় গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব। ভারতে একই ধর্মে জাতপাতভেদের দ্বন্দ্ব মূলত বর্ণাশ্রম বিষয়ে। শেষটা বাদে বাকি দুটোতে ধর্মের কোনও সংসর্গ নেই। শেষেরটাতে ধর্মের চেয়ে শ্রেণিচিন্তা তথা বৈষম্যেরঅবদানই বেশি। সুতরাং বিশ্বে ঘটমান হাঙ্গামায় ধর্মই একমাত্র অনুষঙ্গ নয়।
কর্পোরেট বিশ্বে সত্যিকার অর্থে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি এগুলো হাঙ্গামা সৃষ্টির উপাদান মাত্র, কারণ নয়। কারণ হলো অর্থনীতি, অন্য কথায় বানিজ্য। সাউথ ও সাউথইস্ট এশিয়ায় হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় সংঘাত। বিশেষ করে মুসলিমদের সাথে বৌদ্ধদের সংঘাত হালের শ্রীলংকাসহ। অনেকে বলেনএর পেছনে রয়েছে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’, তথা এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ক জটিলতা।সুতরাং এখানে ধর্মটাকেই মূখ্য ভাবার আগে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে দেখতে হবে। একই ভাবে জানতে হবে সারাবিশ্বে ধর্ম সংশ্লিষ্ট হাঙ্গামার বিষয়ে খবরের পেছনের খবরটা। অনুষঙ্গ খোঁজার চেয়ে কারণ খোঁজাই এখানে জরুরি। সে অর্থে ‘লাভবান’ কে এ বিষয়টি মাথায় রেখে ‘কজ এন্ড ইফেক্ট’ নিয়ে ভাবতে বসতে হবে।
মূল কথায় আসি। বলছিলাম নারী দিবস বিষয়ে। দিবস এলেই প্রতিপাদ্য নিয়ে অনেকেই উচ্ছসিত হন, পরেই আবারঅন্য দিবসে হারিয়ে যান। দিবসকে উপলক্ষ্য করে লিখতে হবে এমন কথায় যারা বিশ্বাস করেন, তারা খুব বেশি কর্পোরেট। কর্পোরেট বিশ্বে হয়তো তারাই মানানসই। তারপরেওবারবার বলি, নারীদের পুরুষের সমকক্ষ হবার প্রচেষ্টার চেয়ে সত্যিকার মানুষ হবার চেষ্টা করাই সঙ্গত। কথিত অনেক নারী নেতৃত্ব ও নারীবাদীরা মূলত পুরুষে উন্নীত হবার চেষ্টাতেই বিভোর, ফলে তাদের আর মানুষ হওয়া উঠছে না।
মানুষের কোন লিঙ্গান্তর হয় না। অনেক পুরুষও মানুষ উঠতে পারেন না, সে কথাটি হয়তো নারী নেতৃত্ব বা নারীবাদীরা বিস্মৃত হয়েছেন। ফুটনোট : সংগ্রামী মানুষেরা কখনো ‘কোটা’র আড়ালে আপোষকামী সুবিধা নিতে চায় না। সে নারীই হোক আর পুরুষই হোক, কিংবা হোক তৃতীয় লিঙ্গের।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
আপনার মতামত লিখুন :