লাইভ সায়েন্স: সবচেয়ে কাছ থেকে তোলা সূর্যের ছবি প্রকাশ করেছে নাসা। এসব ছবি পাঠিয়েছে নাসার মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রোব। এই মহাকাশযানটি সূর্যের পৃষ্ঠের মাত্র ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মাইল (৬ দশমিক ১ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূর থেকে ঐতিহাসিক ছবি তোলে।
প্রকাশিত নতুন ছবিগুলো সৌর বায়ুর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে, যা গবেষকদের এই রহস্যময় মহাজাগতিক আবহাওয়ার উৎস ও পৃথিবীতে এর প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সৌর বায়ু হলো সূর্যের বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের অংশ বা করোনা থেকে নির্গত চার্জযুক্ত কণার (প্রধানত প্রোটন ও ইলেকট্রন) প্রবাহ। এই কণাগুলো প্রতি ঘণ্টায় ১০ লাখেরও বেশি মাইল গতিতে ছুটে চলেছে। এই কণাস্রোত চৌম্বক ক্ষেত্র ও সূর্য থেকে নির্গত বস্তু মিলিয়ে তৈরি করে অরোরা, গ্রহের বায়ুমণ্ডল ক্ষয় করে, এমনকি পৃথিবীর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে। তাই মহাকাশচারী ও মহাকাশযানের সুরক্ষার জন্য এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অবকাঠামোগত ক্ষতি রোধে এই মহাজাগতিক আবহাওয়া পূর্বাভাস জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পার্ক সোলার প্রোব উৎক্ষেপণ হয় ২০১৮ সালে। সূর্যের করোনায় প্রবেশ করা সর্বপ্রথম প্রথম মহাকাশযান। এতে রয়েছে অত্যাধুনিক কিছু যন্ত্র, যেমন—ওয়াইড ফিল্ড ইমেজার ফর সোলার প্রোব (ডব্লিউআইএসপিআর) এবং সোলার উইন্ড ইলেকট্রনস আলফাস অ্যান্ড প্রোটনস (এসডব্লিউইএপি)। প্রবল তাপ ও তেজস্ক্রিয়তা উপেক্ষা করে এই যান সূর্য ও তার পারিপার্শ্বিক এলাকা থেকে বিশদ তথ্য পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে।
গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর পার্কার সোলার প্রোব সূর্যের সবচেয়ে কাছ দিয়ে উড়ে যায় এবং সেটির তোলা ছবিতে দেখা যায়, কীভাবে সৌর বায়ু করোনা ছাড়ার পর আচরণ করে। এতে ধরা পড়ে একের পর এক সৌর প্লাজমা ও চৌম্বক ক্ষেত্রের বুদ্বুদের (করোনাল মাস ইজেকশনস বা সিএমই) সংঘর্ষের চিত্র।
জনস হপকিন্স অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরির উইএসপিআরের বিজ্ঞানী অ্যাঞ্জেলোস ভুরলিডাস বলেন, ‘এই ছবিগুলোতে আমরা দেখছি সিএমইগুলো একটার ওপর আরেকটা জড়ো হচ্ছে। আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, কীভাবে এই সিএমইগুলো একত্রিত হয়—এটি মহাজাগতিক আবহাওয়া বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
সৌর বায়ু দুই ধরনের হয়—দ্রুত গতি সম্পন্ন সৌর বায়ু প্রতি সেকেন্ডে ৮০০ কিলোমিটার গতিতে এবং তুলনামূলকভাবে একটানা বয়ে যায়। অন্যদিকে, ধীর গতির সৌর বায়ু অধিক ঘন এবং এটি অনেকটা ঝোঁকের মতো আসে।
পৃথিবীর আশপাশে সৌর বায়ু সাধারণত একটানা মৃদু বাতাসের মতো অনুভূত হয়। তবে পার্কার সোলার প্রোবের পূর্ববর্তী তথ্য জানায়, সূর্যের কাছাকাছি এই বায়ু অনেক বেশি প্রবল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে দেখা যায় অতিরিক্ত অস্থিরতা, যার রূপ আঁকাবাঁকা চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মতো—যাকে বলা হয় ‘সুইচব্যাক’। এই সুইচব্যাকগুলো সূর্যের পৃষ্ঠের দৃশ্যমান চুম্বকীয় অঞ্চলে গঠিত ফানেল বা চোঙাকৃতি গঠন থেকে উৎসারিত বলে ধারণা করা হয়। ২০২৪ সালে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেন, দ্রুতগতির সৌর বায়ু আংশিকভাবে এই সুইচব্যাকের মাধ্যমেই চালিত হয়।
তবে ধীর সৌর বায়ুর উৎস এত দিন অজানাই ছিল।
আগের পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, ধীর সৌর বায়ু হয় দুই ধরনের—আলভেনিক (Alfvénic), যেটিতে ছোট চুম্বকীয় সুইচব্যাক থাকে এবং নন-আলভেনিক, যেটিতে এসব অনুপস্থিত। পার্কার সোলার প্রোবের সর্বশেষ উড়ানে এই বহু পুরোনো অনুমান প্রথমবারের মতো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
নতুন ছবিগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, দুই ধরনের ধীর সৌর বায়ুর উৎস ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে। আলভেনিক সৌর বায়ু সম্ভবত সূর্যের ঠান্ডা ও কম ঘনত্বের অংশ, যাকে করোনা হোল বলা হয়, সেখান থেকে আসে। আর নন-আলভেনিক সৌর বায়ু সৃষ্টি হয় সূর্যের গরম, চুম্বকীয় লুপের মতো গঠনের জায়গা থেকে, যেগুলোকে হেলমেট স্ট্রিমার বলা হয়।
নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের পার্কার সোলার প্রোব মিশনের বিজ্ঞানী অ্যাডাম স্যাবো বলেন, ‘আমরা এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসিনি, তবে আমাদের কাছে এখন অনেক নতুন এবং রোমাঞ্চকর তথ্য আছে।’
পার্কার সোলার প্রোব আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর আবার সূর্যের সবচেয়ে কাছ দিয়ে উড়ে যাবে। এই সময় নতুন তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সূর্যের রহস্য আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ তৈরি হবে।
তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা