সকাল হতেই কাস্টমারের হাঁকডাক। লুচি-পরোটায় নাশতার পর রোজেলা-চায়ের অর্ডার। বাংলোর আদলে 'লুচি ঘর' নামক গারো রেস্তোরাঁয় রোজেলা-চায়ের সঙ্গে কফি, খিচুড়ি, ডালভাত ও শাক পাতার হরেক রকম খাবার হয়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে সব শ্রেণির ভোক্তার কাছে রোজেলা-চায়ের টানে 'লুচি ঘর' এখন সবার প্রিয়।
দেশি বিদেশি পর্যটকরা টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে বেড়াতে এলে পঁচিশমাইল সড়কে দীপক রেমার লুচি ঘরের রোজেলা-চায়ের স্বাদ নিতে ভোলেন না। স্ত্রী বিনীতা চিরানকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোরাঁটি তিনি চালান। আগে সিলেট চট্টগ্রাম থেকে রোজেলা কিনে আনতেন। এখন নিজেই আবাদ করেন। অফলাইন, অনলাইনে বিক্রি এবং রেস্তোরাঁয় পানীয় হিসাবে বেচেবর্তে বেশ আছেন তারা।
দীপক রেমার বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কান্দাপাড়া। দুই যুগ আগে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলের রাজাবাড়ী গ্রামের বিনীতা চিরানকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে আসেন। আবাদী জমিজমা না থাকায় জলছত্র ক্যাথলিক খৃষ্ট মিশনের উলটোদিকে 'লুচি ঘর' রেস্তোরাঁয় রোজেলা-চা বেচা আরম্ভ করেন। তিনি জানান, ঢাকায় একটি রেস্তোরাঁয় চাকরিকালে উঁচু দামে ভেষজ রোজেলা-চা বিক্রি হতে দেখে উৎসাহিত হন। সিলেট ও নাটোর থেকে বীজ আনিয়ে বাড়ির পতিত জমিতে রোজেলা আবাদ করেন। ভালো ফলন পান। এরপর দুই বিঘা জমি মেয়াদি নিয়ে রোজেলার আবাদ শুরু করেন। রোজেলা দেখতে পাটগাছের মতো। মে মাসে রোপণ করা চারায় নভেম্বরেই টুকটুকে লাল ফুল ও গুটি আসে। গুটির বিচি থেকে পাপড়ি আলাদা করা হয়। এ পাপড়ি তিন-চার দিন রোদে শুকিয়ে নিলে আমের ফলির মতো হয়। এ শুকনো পাপড়ির তিন-চার খণ্ড পানিতে দুই-তিন মিনিট জাল দিলেই নির্যাস গাঢ় লালচে হয়। হালকা চিনি, মধু, লবণ এবং কাঁচা মরিচের ছোট্ট কুঁচি মিশিয়ে নিলেই ভেষজ চায়ের স্বাদ মেলে।
দীপক রেমা জানান, মধুপুর গড়ের লাল মাটিতে ফলন আশাপ্রদ। আট মাসের ফসল থেকে ৩০ শতাংশের এক বিঘায় লাখ টাকা আয় হয়। গাছে রোগবালাই নেই। সার বা নিড়ানি লাগে না। আবাদে কোনো খরচ নেই। প্রতি কেজি রোজেলা অনলাইন অফলাইনে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। গাছের পাতা শাক হিসাবে খাওয়া যায়। শুকনো গাছ পাটখড়ির মতোই উত্তম জ্বালানি। বীজ শুকিয়ে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে পশুখাদ্য বানানো যায়।
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক জানান, ভেষজ গুণসমৃদ্ধ রোজেলা-চা এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক কাপ রোজেলা-চা ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। তিনি আরো জানান, এক সময়ে শালবনে প্রচুর রোজেলা মিলত। এখনো গারো পাড়ায় কিছু কিছু দেখা যায়। গারো ও কোচরা একে চুকা গোটা নামে চেনে। গুটি ও পাতা নানা খাদ্য-খাবারে ব্যবহার হয়। কবিরাজী চিকিৎসার কাঁচামাল হিসাবেও চাহিদা রয়েছে। পুডিং, চকোলেট, জুস, জ্যাম, জেলি, আচার, চাটনি, গারো চু বা মদ এবং মুখরোচক পানীয় তৈরিতে এটি আদৃত ভারতীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের জনক উইরিয়াম রক্সবার্গ 'ফ্লোরা ইন্ডিকা' গ্রন্থে জানান, এটির আদিভূমি আফ্রিকা। মালভেসি পরিবারের এ উদ্ভিদে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে।
কমলালেবুর ৯ গুণ এবং পেয়ারার আড়াই গুণ বেশি ভিটামিন সি রয়েছে। রয়েছে বি-ওয়ান, বি-টু, বি-সিক্স, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও প্রোটিন। কৃষিবিজ্ঞানী ড. এফএ হাসান নাজমুল জানান, খাগাড়াছড়ি ও নাটোরে কিছুটা বাণিজ্যিকভাবেই এর আবাদ হয়। বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানো গেলে কৃষিক্ষেত্রে সফলতা আসবে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব হবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির রোজেলা উদ্ভিদ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। সম্প্রতি মিডিয়াকে তিনি জানান, এর পাতা ও ফল ওষুধিগুণে ভরপুর। এর খাদ্য ও পানীয় ক্লান্তি দূরীকরণ, হৃদ্রোগ উপশম, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যুসারে কেমোথেরাপির পরবর্তী দ্রুত সুস্থতার জন্য খুবই উপকারী।
সূত্র: ইত্তেফাক