এক সময় আলো, আড্ডা আর রাজনীতিতে মুখর থাকত বনানীর সেই বাড়ি। ঝড়বাতির আলোয় জমে উঠত নীতির বিতর্ক, সিদ্ধান্তের মঞ্চ। আজ সেই বাড়ি যেন এক বেওয়ারিশ স্থাপনা— রান্নাঘর, শোবার ঘর, ড্রয়িংরুম, এমনকি ছাদে ওঠার সিঁড়িও ভেঙে গেছে, ভেসে আছে ধ্বংসের চিহ্ন।
বারান্দায় কাঁটামুকুট গাছের ঝোপে এখন সময়ের ক্ষতচিহ্ন। খয়েরি হয়ে যাওয়া পাতায় জমে আছে ধুলা, পানির ছোঁয়া পায় না আর। এই নীরব বাড়িটিঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বনানীর বাসভবন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নির্মিত বাড়িটি এক সময় ছিল তার পরিবারের আবাস।
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট— হাসিনা সরকারের পতনের রাতে ছাত্রজনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়ে যায় এই প্রাসাদ। তারপর থেকেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল বাড়িটি। সম্প্রতি অবশ্য বাড়ির চারপাশে নতুন করে সীমানা প্রাচীর তোলা হয়েছে, গেটে নিয়োজিত নিরাপত্তারক্ষী ও ভেতরে এক কেয়ারটেকারও আছেন।
কেয়ারটেকার জানালেন, ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে *সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বসানো হচ্ছে, ভাঙা অংশ মেরামত চলছে। তার দাবি, সাঈদ খোকনের পরিবার থেকেই একটি বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে এই সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে আদালত সাঈদ খোকনের গুলশান ও বনানীর তিনটি বাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছিল। ফলে বনানীর এই বাড়িতে সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, আদালতের অনুমতি ছাড়া এ কাজ কীভাবে সম্ভব?
গুলশান লেক পেরিয়ে একটু এগোলেই দেখা মেলে আরেক সাবেক মেয়রের পরিত্যক্ত বাড়ি— ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বনানী ১৮ নম্বর সড়কের বাসভবন। আগুনে পোড়া গেটের ওপারে পড়ে আছে জ্বলে যাওয়া গাড়ির জঞ্জাল।*প্রহরীদের কেউই কথা বলতে চান না। একজন জানান, “ভেতরে কিছুই নেই ভাই। চারটা গাড়ি ছিল, সব পুড়ে গেছে। আসবাবপত্র যা ছিল, লোড করে নিয়ে গেছে সবাই।”
তাপসের বিরুদ্ধেও মেয়র থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সরকারের পতনের ঠিক আগমুহূর্তে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। বর্তমানে তার বাড়িটিও কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা।
একই চিত্র সালমান এফ রহমানের গুলশানের পোনার বাড়িতে। শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা ও শিল্পপতি সালমানের এই প্রাসাদেও ঢুকতে দেওয়া হয় না কাউকে। নিরাপত্তা রক্ষীরা বলেন, “ছবি তোলা যাবে না, সমস্যা আছে ভাই।”
জানা গেছে, বাড়ির ড্রয়িংরুমে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সহ বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম শোভা পেত, যেগুলোর বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি। এখন সেগুলোর অস্তিত্বও অনিশ্চিত।
বাড়ির সিকিউরিটি ইনচার্জ জানান, সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন গ্রুপের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা টহল বসানো হয়েছে। “ময়লার কিছুটা পরিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু পোড়া গাড়িগুলো আগের মতোই পড়ে আছে। তদন্ত দল মাঝে মাঝে আসে, তাছাড়া কেউ থাকে না।”
একসময় যেসব বাড়ি ছিল ক্ষমতার প্রতীক, রাজনীতির দুর্গ, আজ সেগুলো নিঃসঙ্গ, পোড়া ও পরিত্যক্ত। তাদের মালিকরা কেউ কারাগারে, কেউ বিদেশে।
আর বনানী-গুলশানের অভিজাত প্রাসাদগুলো এখন সময়ের সাক্ষী— রাজনীতি, ক্ষমতা আর পতনের নীরব গল্প বলছে। সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ