এল আর বাদল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনে অতীতে কখনও জয়ের কাছাকাছি যাওয়া, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেনি ইসলামী ছাত্রশিবির। জামায়াতে ইসলামীর এই সহযোগী সংগঠনটি এবার ভূমিধস জয় পেয়েছে।
ছাত্র শিবিরের এই জয়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলের প্রার্থীদের ভোটের ফারাকটা অনেক। আর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভরাডুবি হয়েছে। ---- বিবিসি বাংলা
অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনে জাতীয় নির্বাচনের কয়েকমাস আগে ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজনীতিতে চলছে নানা আলোচনা। এর কোনো প্রভাব আগামী সংসদ নির্বাচনে ও জাতীয় রাজনীতিতে পড়তে পারে কি না, এমন প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন।
এদিকে, যেভাবে পরাজিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, সেই বাস্তবতা সম্পর্কে সংগঠনটির এবং বিএনপির ধারণা ছিল না বলে তাদের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে মনে হয়েছে।
এছাড়া তাদের প্রস্তুতিতেও ঘাটতি ছিল বলে সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলছেন। তবে রাজনীতিকদেরই অনেকে মনে করছেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা যেতে চায়, তাদের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলের জন্যই বার্তা রয়েছে এবং সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
রাজনীতিকদের অনেকে আবার ডাকসুর প্রভাবের বিষয়কে সেভাবে গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচন থেকে সমগ্র বাংলাদেশকে বিবেচনা করার কোনো কারণ নেই। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে চলেছে পর্যালোচনা,বিশ্লেষণ।
যদিও ছাত্রদল ডাকসুর ফলাফল প্রত্যাখান করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি অস্থির হলে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা বাড়তে পারে, সেই দায় এড়াতে ছাত্রদল ও বিএনপি বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে বলে নেতাদের কেউ কেউ বলছেন।
এছাড়া বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ডাকসুর ফলাফল নিয়ে যাতে কোনো সংঘর্ষ বা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল না হয়, সে ব্যাপারে মঙ্গলবার সেই নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকেও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। শেষপর্যন্ত ভিন্ন কোনো অবস্থানে যায়নি বিএনপি।
ছাত্রদলের ঘাটতি বা দুর্বলতা ছিল কোথায়
ডাকসুতে বিপর্যয়ের পর বিএনপির ছাত্র সংগঠনটি ভোটে অস্বচ্ছতা, অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগ করেছে প্রকাশ্যে। ছাত্রদল ও বিএনপি নেতাদের অনেকে এমন অভিযোগও করছেন যে, ডাকসুর ভোটের ব্যাপারে ছাত্রলীগের সঙ্গেও ছাত্রশিবিরের আঁতাত হয়েছিল।
ছাত্রশিবির অবশ্য এসব অভিযোগ মানতে রাজি নয়। তবে ছাত্রদল ও বিএনপির নেতৃত্ব প্রাথমিকভাবে নিজেদের কিছু দুর্বলতার বিষয়ও চিহ্নিত করেছে বলে জানা গেছে।
প্রথমত, ডাকসু নির্বাচনের শুরু থেকে তাদের কর্মকাণ্ড চলেছে এডহক ভিত্তিতে। ছিল না সমন্বিত পরিকল্পনা। শেষপর্যায়ে যখন বিএনপির নেতৃত্ব ডাকসুর দিকে নজর বাড়িয়েছে, তখন ছাত্রদল ও মূল দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় হয়েছেন।
কারণ হিসেবে বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বড় সংগঠন হিসেবে ছাত্রদল প্রার্থীরা জয়ী হবেন, কিন্তু এতটা বিপর্যয় হবে-সেই ধারণা তাদের ছিল না। নির্বাচনে যে নানারকম কৌশল থাকে, তাতেও তাদের ঘাটতি ছিল।
বিজয় হবে, এমন ধারণা থেকে ছাত্রদল একক প্যানেল দিয়েছিল। তবে ছাত্রশিবিরের বাইরে অন্য প্যানেলগুলো যে সংখ্যায় ভোট পেয়েছে, তা ছাত্রদলের ভোটের সঙ্গে যোগ করলে শিবিরের ভোটের চেয়ে সংখ্যায় বেশি হয়। সেখানে ছাত্রদলের ঐক্যবদ্ধ প্যানেল তৈরির কোনো চেষ্টা ছিল না।
কিন্তু ছাত্রশিবির কোনো কোনো পদে তাদের সংগঠনের বাইরে প্রার্থী করে 'ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের' নামে বা ভিন্ন ব্যানারে প্যানেল দিয়েছিল। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ছাত্রদলের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন।
তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনে নিপীড়ণের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি ছাত্রদল।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা আবাসিক হলে অবস্থান করে ছাত্র সংগঠনটি যেহেতু কর্মকাণ্ড চালাতে পারেনি, ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের রিক্রটমেন্ট বা সদস্য সংগ্রহ সেভাবে হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষর্থীদের দিয়ে শক্ত অবস্থান বা সেভাবে প্রভাব এখনও তৈরি করতে পারেনি ছাত্রদল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর অবস্থান নড়বড়ে। জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের দল এনসিপি সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবও কমেছে। ডাকসুর ফলাফলে সেটাই প্রমাণ হয়।
এর বিপরীতে দেখা গেছে, বছরের পর বছর ধরে ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারলেও গোপনে বা কৌশলে তারা তাদের সংগঠনের বিস্তার ঘটিয়েছে।
এমনকি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের পদ-পদবী নিয়েও ছাত্রশিবিরের কোনো কোনো নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের পতনের পর তারা প্রকাশ্যে এসেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, ছাত্রশিবিরের উত্থানের জন্য দায়ী ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ।সেই আওয়ামী লীগ সরকার ও ছাত্রলীগের নিপীড়নের কারণে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ক্যাম্পাসগুলোতে কার্যক্রম চালাতে পারেনি।
অন্যদিকে,ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় ছাত্রশিবির গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়েছে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
ফলে বিশ্লেষকদের পাশাপাশি বিএনপি নেতাদেরও অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলের শক্ত ভিত্তি না থাকার বিষয়কে ডাকসুতে বিপর্যয়ের অন্যতম একটি কারণ হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকদের অনেকে আবার ছাত্রদলের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থার প্রশ্নও তুলছেন।তাদের বক্তব্য হচ্ছে, অতীতে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতার দাপটে ছাত্রদলের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল।
আর আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অপরাধের অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের শাসনে যেমন ক্যাম্পাসগুলোতে আবাসিক হল দখল ও গণরুমে নিপীড়নের আভিযোগ রয়েছে। অতীতে বিএনপি সরকারের সময়ও হলগুলোতে গণরুম ও নিপীড়নের অভিযোগ ছিল।
শিবিরের প্রচারণায় ছিল না ধর্মভিত্তিক বক্তব্য
ডাকসুতে প্যানেল দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং নির্বাচনী প্রচারণাতেও কৌশলী ছিল ছাত্র শিবির। তারা 'ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থীর জোটের' ব্যানারে প্যানেল দিয়েছিল।
তবে তাদের বড় কৌশল ছিল নির্বাচনী প্রচারণায়। জামায়াতের সমর্থক সংগঠন হলেও ছাত্রশিবির ডাকসুতে প্রচারণায় ধর্মভিত্তিক ও ডানপন্থী চিন্তার বিষয়গুলো আনেনি। অন্য দলগুলোরও নজরে এসেছে শিবিরের এই কৌশল।
জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ডানপন্থী বা ধর্মভিত্তিক বক্তব্য না টেনে ছাত্রশিবির মধ্যপন্থী জায়গা থেকে ডাকসু নির্বাচন পরিচালনা করেছে, সেটি তাদের জয়ের পক্ষে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।"
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে এখনও যে প্রশ্ন রয়েছে, ডাকসু নির্বাচনে সেই '৭১ প্রসঙ্গও আনেনি ছাত্রশিবির।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দশকের পর দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান তৈরির চেষ্টা ছিল।
সেজন্য দীর্ঘ সময় তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে কর্মকাণ্ড চালিয়ে তাদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়েছে। আর এর সঙ্গে গত বছরের অগাস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ওই ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য অবস্থান দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়।
এখন ডাকসুই তাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ডাকসুতে এই প্রথম ছাত্রশিবিরের ভূমিধস জয়ের ঘটনা রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে কি
গত এক বছরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়েছে। সংস্কার ও নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে দলদুটির অবস্থান বিপরীতমুখী।
ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় জামায়াত। দলটির নেতারা এখনও তাদের সেই অবস্থানে অটল থাকার কথাই বলছেন।
আর বিএনপি রয়েছে বিদ্যমান সরাসরি ভোটের পক্ষে। বিএনপি কেন্দ্রীয় একজন নেতা বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অসন্তুষ্টি রয়েছে। ফলে তাদের সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব আরও বাড়তে পারে।
এছাড়াও বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন,যদিও ডাকসুতে সরাসরি ভোটে ছাত্রশিবির জিতেছে। কিন্তু এই জয়ের পর জামায়াত সংসদে পিআর পদ্ধতির দাবিকে আরও জোড়ালোভাবে সামনে আনতে পারে।
অন্যদিকে, ডাকসু নির্বাচনের পর সরকারও ভিন্ন কোনো কৌশল নেয় কি না এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আবার কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি হয় কি না, এমন সন্দেহ তৈরি হয়েছে বিএনপির কারও কারও মধ্যে।
তবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে বা সংসদ নির্বাচনে ডাকসুর প্রভাব পড়বে বলে তারা মনে করেন না।
বিএনপির মিত্রদের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোটের নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তারা বলছেন, জাতীয় রাজনীতি ও সংসদ নির্বাচনের বিশাল মঞ্চে ডাকসুর প্রভাব পড়ার কোনো সুযোগ নেই।
ইসলামপন্থি দলগুলোর নেতাদের অনেকে আবার ভিন্ন ধারণা তুলে ধরছেন। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক যে দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে এক মঞ্চে আসার চেষ্টা করছে।
তাদের মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ডাকসুতে শিক্ষার্থীরা দখল-চাঁদাবাজির পুরোনো রাজনীতিকে প্রত্যাখান করে বিকল্প বেছে নিয়েছে। এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে এখন তারা মনে করছেন।
তবে, জাতীয় রাজনীতি ও সংসদ নির্বাচনে ডাকসুর ভোটের প্রভাব আসলে পড়তে পারে কী না, সেই প্রশ্নে রাজনীতিকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত বা আলোচনা রয়েছে।
কিন্তু বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মানুষের আস্থা অর্জনে রাজনীতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন, ডাকসুর নির্বাচন থেকে সব দলের জন্যই একটা বার্তা দিয়েছে।