বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে দেওয়া বিতর্কিত একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নিজের প্রাণনাশের শঙ্কা করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ফজলুর রহমান। দেশ-বিদেশ থেকে হত্যার হুমকি পাচ্ছেন, এমনকি একদল ব্যক্তি মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তার বাসভবন পর্যন্ত চলে গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
"অপমৃত্যুটা কি আমার কাম্য?," প্রশ্ন করেছেন মি. রহমান।
পেশায় আইনজীবী বিএনপির এই নেতা বলেছেন, তার বক্তব্যে কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
"যদি কোনো কথা তোমরা মনে করে থাকো যে, আমি দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছি বা তোমাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলছি, আমার বিরুদ্ধে মামলা করো, আমাকে গ্রেফতার করো, আমাকে শাস্তি দাও"
"কিন্তু আমাকে হত্যা করার জন্য আমার বাসা পর্যন্ত মব সৃষ্টি করে গিয়া, যেটা গত একবছর যাবৎ বাংলাদেশে এবং পৃথিবীতে সবচেয়ে কুখ্যাত নাম মব, সেই মব জাস্টিস আমার ওপরে চলতে পারে কি-না এবং চলবে কি-না, আমি প্রথমে বাংলাদেশের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করতে চাই," সাংবাদিকদের বলেন মি. রহমান।
সোমবার দুপুরে তিনি যখন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিলেন, তখনও দশ-বারো জনের একদল ব্যক্তি ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকা অবস্থিত মি. রহমানের ভাড়া বাসার সামনে বিক্ষোভ করছিলেন।
এ অবস্থায় নিজের এবং পরিবারের সদস্যের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বলে জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা।
"আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী সবার কাছে আহ্বান করতেছি, আপনারা আমার মৌলিক অধিকার এবং আমার সন্তানদের বেঁচে থাকার অধিকার, আমার স্ত্রীর বেঁচে থাকার অধিকার আপনারা দয়া করে নিশ্চিত করুন," বলেন মি. রহমান।
বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খবর দেন ফজলুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা। এরপর ঘটনাস্থলে আসেন সেনা বাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা। বিকেল পর্যন্ত তারা ঘটনাস্থলেই অবস্থান করছিলেন।
এদিকে, ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
"ফজলুর রহমান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেজন্য ইতোমধ্যেই তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জবাব হাতে পাওয়ার পর দল তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। এরপরও এ ধরনের ঘটনা মোটেই কাম্য নয়," বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমেদ।
সকাল থেকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার প্রতিবাদে সোমবার সকাল থেকে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানান বিক্ষোভকারীরা।
এ নিয়ে ফজলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, "আমি শুনলাম স্লোগান হচ্ছে কয়েকটা। দেখলাম ওপর থেকে সাত থেকে আটজন ছেলেমেয়ে স্লোগান দিচ্ছে, খুব বিশ্রি স্লোগান। ফজলুকে হত্যা করো, ফজলুর রহমানকে গ্রেফতার করো ইত্যাদি, ইত্যাদি"
"সাত-আটজন ছেলেমেয়ে এবং তারা বাসার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেছে। আমি সেই বাসায় থাকি, ভাড়া বাসা। আমি এখন শঙ্কায় আছি যেই বাসায় ভাড়া থাকি সেই মালিক এখন আমাকে আর ভাড়ায় বাসায় থাকতে দেবে কি না," বলেন মি. রহমান।
'বিপ্লবী ছাত্র জনতা' ব্যানারে আয়োজিত ওই বিক্ষোভে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, জুলাই রাজবন্দীসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীদেরকে অংশ নিতে দেখা গেছে।
বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও স্লোগানে স্লোগানে তারা বিএনপি থেকে মি. রহমানের স্থায়ী বহিষ্কার ও গ্রেফতারের দাবি জানান।
"ফজলুর রহমান জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, জুলাই অবমাননা করেছেন। আমরা তার শাস্তি চাই। বিএনপি থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে," সাংবাদিকদের বলেন এক বিক্ষোভকারী।
এসব দাবি না মানা পর্যন্ত বিএনপি নেতার বাসার সামনে থেকে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
"ফজলুর রহমান যে দাম্ভিকতা দেখিয়েছেন, সেটার জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তাকে গ্রেফতার করতে হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা অবস্থান চালিয়ে যাবো," 'জুলাই রাজবন্দি' নামে একটি সংগঠনের নেতা পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন মাহাদী হাসান নামের একজন বিক্ষোভকারী।
সকালে বিক্ষোভকারীরা প্রথমে মি. রহমানের বাড়ির সামনের সড়ক, যেটি দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ের সামনে অবস্থিত, সেখানে অবস্থান নেন। এতে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
পরে সেনা ও পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে তাদেরকে সরানোর চেষ্টা করে।
"কথা বলে তাদেরকে আমরা সড়কের মাঝখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। আপাতত তারা রাস্তার একপাশে অবস্থান নিয়েছেন। আমরাও এখানে আছি। আশাকরি, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা অঘটন ঘটবে না," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকার রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম ফারুক।
কী বলেছিলেন ফজলুর রহমান?
সম্প্রতি টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় মি. রহমান জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা নিয়ে এমন কিছু কথা বলেন, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
জামায়াতকে "কালো শক্তি" আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ''যারা পাঁচই আগস্ট ঘটাইছে, কালো শক্তি, সেই কালো শক্তির নাম হল জামায়াতে ইসলাম, তাদের যে অগ্রগামী শক্তি তার নাম হইল ইসলামী ছাত্রশিবির।"
আন্দোলনের ছাত্র সমন্বয়কদের বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা বলেন, "সারজিস আলমরা, যারা ওই এইটায় (গণঅভ্যুত্থানে) অভিনয় করছে, পাঁচই আগস্টের অভিনেতা যারা, আমি তাদেরকে নেতা বলতে আর চাই না, তাদের আমি অভিনেতা বলবো।"
"সেই আলবদর, আল শামস, জামায়াতে ইসলাম আমরা মনে করেছিলাম ৫৪ বছর পর পূর্বপুরুষের পরাজয়ের গ্লানি তারা ভুলে গেছে। কিন্তু না, সেই পরাজয়ের গ্লানি দ্বিগুণ আকারে তাদের মধ্যে এসেছে," বলেন ফজলুর রহমান।
এ ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মি. রহমানের কথার প্রতিবাদ জানানো হয়।
রোববার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ করে বিএনপি'র এই নেতার কুশপুত্তলিকাও দাহ করতে দেখা গেছে।
এছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান।
"বিদেশ থেকে কিছু ইউটিউবার, বিশেষ করে ফ্রান্স থেকে, কয়েকদিন আগে দুইজন ইউটিউবার অর্ডার দিয়েছে আমাকে হত্যা করার জন্য এবং কালকে রাত্রে বা পরশু রাত্রে দেখলাম এরা সবাই জামায়াতের লোক," সাংবাদিকদের বলেন মি. রহমান।
'মব বিএনপি'র সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করতে পারবে না'
জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ফজলুর রহমানের বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে রোববার রাতে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিএনপি। সেখানে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে লিখিতভাবে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
"উনি নোটিশের জবাবে কী বলেন, সেটা দেখে দল তার ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে," বিবিসি বাংলাকে জানান বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
এক্ষেত্রে মব বা অন্য কোনোভাবে কেউ বিএনপি'র সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করতে পারবে না বলে জানান দলটির এই নেতা।
"মব বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে আমরা কখনোই উৎসাহিত বা সমর্থন করি না। সেটা হতে পারে না। আমাদের ওপরে কোনো ধরনের চাপ নাই, থাকার প্রশ্নও নাই," বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমেদ।
ফজলুর রহমানকে বিএনপি যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে, সেখানে বলা হয়, "আপনি জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ক্রমাগত কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে আসছেন এবং আত্মদানকারী শহীদদের নিয়ে যে বক্তব্য দিচ্ছেন তা সম্পূর্ণরুপে দলীয় আদর্শ ও গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী। মহিমান্বিত এই গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন নিয়ে আপনার বক্তব্য জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।"
আরও উল্লেখ করা হয়, তার বক্তব্য দলের সুনাম ক্ষুন্ন করার সুপরিকল্পিত চক্রান্তের প্রয়াস বলে অনেকেই মনে করে। এমনকি জনগণের ধর্মীয় অনুভুতিতেও আঘাত দিয়ে কথা বলছেন মি. রহমান।
সোমবার রাত নয়টার দিকে দলের নোটিশ হাতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি চিঠির জবাব দিবেন বলে জানিয়েছেন।
"আমি নির্দিষ্ট সময়ে উত্তর আমার দলকে দেবো এবং আমার দল আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত যা দেবে, সেটা আমি মাথা পেতে মেনে নেবো," সাংবাদিকদের বলেন মি. রহমান।