আজিজুর রহমান আসাদ: গত মাসে আমি কয়েকটি জেলা শহরে ঘুরেছি, পুরনো ঐতিহ্য খুঁজেছি, যা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঠিক রক্ষা করতে পারছে না বা চাইছে না। অনেক পুরনো স্থাপনা বেহাত হয়েছে। আমি বইপড়া, গান শোনা, কবিতা লেখা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা ও চর্চা অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে জানা, বোঝার চেষ্টা করেছি। বাঙালি সংস্কৃতির বর্তমান চর্চা নিয়ে অনেক আলাপের তিনটি উল্লেখযোগ্য। [১] স্মার্ট ফোনের ব্যবহার, বিনোদন মাধ্যম হিসেবে। বিশেষ করে রিল দেখা হয় যেখানে সম্প্রতি পিনাকী ও সলিমুল্লা খান জনপ্রিয়, হিরো আলমের তুলনায়। নীল বা নরম-নীল ছবি দেখা, ওয়াজ শোনা, হিন্দি বা বাংলা সিরিয়াল দেখা এবং গান শোনাও ঘটে। [২] গান বাজনা শেখার চর্চা শুধু হিন্দু পরিবারে আছে। তবে আগের মতো বাড়িতে নয়, কোনো কেন্দ্রে গিয়ে অনুশীলন করে যাতে মুসলমান প্রতিবেশীরা বিরক্ত না হয়, হামলা না করে, এই ভয়ে।
[৩] বিনোদনের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। আগে ওয়াজ ছিল ধর্মীয় জ্ঞান দেয়ার ব্যাপার, এখন তা ‘ইসলামিক বিনোদন’। ইদানীং শিশুদের নাম রাখা হচ্ছে অপরিচিত আরবিতে। ‘ভালোনাম’ এবং ‘ডাকনাম’ দুটোই। এই দেশে একসময় মুসলমান পরিবারে ডাকনাম ছিল বাংলায়; সজল, সবুজ, স্বপন, রতন, কিংবা কেয়া, কুমকুম, কবিতা। বর্তমানে আমার পরিচিত অনেক লোকের সন্তানদের নাম মনে রাখা কঠিন। কারণ তা অপরিচিত আরবিতে। পোশাকের, বিশেষ করে নারীর পোশাকের ক্ষেত্রে যে মরুসাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন তা প্রকট। ভাষার ক্ষেত্রে আরবি, হিন্দি এবং ইংরেজির নানা মাত্রায় প্রভাব বাড়ছে ও কমছে। বাংলাদেশে ‘মুসলমানি’ বাংলা চালু করার একটি চেষ্টাও দেখা যায়। একটি সমাজে যা কিছু দৃশ্যমান, যেমন ভাষার ব্যবহার, পোশাক, খাবার, ধর্মাচার, সাহিত্য, শিল্পকলা, সংগীত, গৃহসজ্জা, ইত্যাদি যা আমরা সংস্কৃতি বলি, এই সংস্কৃতি রাজনীতি বিচ্ছিন্ন বা রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। প্রতিটি ঘরে ঘরে যে সংস্কৃতিকচর্চা, যেমন সন্তানের নাম, পোশাক, বইপত্র, খাদ্য, বিনোদন উপরকরণ, তা প্রকাশ করে একটি সমাজের রাজনৈতিক প্রভাব ও ওই সমাজের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চেহারা। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে কোনো ধরনের রাজনীতির প্রভাব বাড়ছে?
সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী ‘ইসলামী’ রাজনীতির প্রভাব। সাম্প্রদায়িক মুসলমান আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ধর্মের নামে। মুসলমানদের নানা তরিকার মধ্যে, যেমন সেক্যুলার, সুফি, মডারেট, এখন মৌলবাদী রাজনীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। যারা মূলত বাঙালি সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করতে চায়, পাকিস্তানি মতাদর্শে। যে মতাদর্শের সবচেয়ে বিকশিত ও সহিংস রূপ দেখা গিয়েছে ১৯৭১ সালে রাজাকার আলবদরের রাজনীতিতে। বাংলাদেশে বাঙালির সংস্কৃতি বিলুপ্ত করে, ধর্মের নামে যে পাকিস্তানি ও মরুসংস্কৃতি প্রসারের চেষ্টা চলছে, সেটা ওই রাজাকার আলবদরের রাজনীতির ধারাবাহ্যিকতায়। ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনের রাজনীতি এই স্বাধীন বাংলায় আক্রমণের মুখে। তবে ইরানের মতো এরা হয়তো রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারবে না, কিন্তু সংস্কৃতি দখল করতে পারবে। সেই চেষ্টার একটি উদহারণ শিশুদের জন্য এই বই। লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :