ড. হুমায়ূন কবীর: আমাদের রক্তপ্রবাহ যখন বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস বা ফাংগাসের সংক্রমণের ফলে বিষাক্ত হয় তখন তাকে ক্লিনিক্যাল পরিভাষায় সেপ্টিসেমিয়া, সেপসিস, ব্লাড স্ট্রিম ইনফেকশন, ব্যাকটেরিয়ামিয়া বা ব্লাড পয়জনিং বলা হয়ে থাকে। কোন কোন অনুজীব সেপ্টিসেমিয়ার জন্য দায়ী? বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া যেমন স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস (এস. অরিয়াস), স্ট্রেপ্টোকক্কাস পাইজেনেস (এস. পাইজেনেস) বা বিভিন্ন প্রজাতির গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া যেমন ক্লেবসিয়েলা ইসপিসিস, এসচেরিচিয়া কোলি (ই. কোলি) বা ভাইরাস যেমন কোভিড১৯, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ফাংগাস যেমন ক্যানডিডা এলবিকান্স এবং অন্যান্য ক্যানডিডা ইসপিসিস প্রধানত সেপ্টিসেমিয়ার জন্য দায়ী।
খুব সম্প্রতিক প্রকাশিত একটি গবেষণা রিপোর্টে (লেনসেট ২০২০) দেখা গেছে, [১] ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৮.৯ মিলিয়ন সেপসিসের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যার মধ্যে ১১ মিলিয়ন মৃত্যু হয়েছে সেপসিস সম্পর্কিত। যা সমস্ত বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর ১৯.৭%। [২] ২০১৭ সালের মোট সেপসিসের ঘটনার প্রায় অর্ধেকই শিশুদের (৫ বছরের কম বয়সী) মধ্যে ঘটে, যা প্রায় ২০ মিলিয়ন এবং ২.৯ মিলিয়ন মৃত্যু হয় বিশ্বব্যাপী। [৩] সেপসিসের ঘটনা এবং মৃত্যুর হার বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে। সাব-সাহারান আফ্রিকা, ওশেনিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব-এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। [৪] বিশ্বব্যাপী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে আনুমানিক ৮৫ শতাংশ সেপসিস কেস এবং সেপসিস সংক্রান্ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেপ্টিসেমিয়া কি ছোঁয়াচে? আমরা একে অপরকে সংক্রামিত করার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু আমাদের কোনো একটা সংক্রমণ বা মারাত্মক দুর্ঘটনার থেকে সেপ্টিসেমিয়া হতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেপ্টিসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি আছে কারা? বয়স্ক ব্যক্তিরা, গর্ভবতী মহিলারা, নবজাতক শিশু, হাসপাতালে ভর্তি রোগী, বিশেষত নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে রোগী, ইমিউনোকম্প্রোমাইজড রোগী যেমন এইচআইভি, ক্যান্সার। দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসাধীন রোগীরা (যেমন কিডনি রোগ, সিরোসিস) সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো কী? সেপ্টিসেমিয়া আক্রান্ত রোগী মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে তাই এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লক্ষণ ও উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। তবে সেপসিস হতে পারে এমন সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের সেবা নেওয়া উচিত। সাধারণ লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো নিম্নরুপ: সাধারণ জ্বর বা নিম্ন তাপমাত্রা এবং কাঁপুনি অনুভব করা, বিভ্রান্তি বোধ করা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ত্বক আঠালো এবং ঘামযুক্ত হওয়া, শরীরে চরম ব্যথা বা অস্বস্তি বোধ করা, উচ্চ হৃদস্পন্দন, দুর্বল পালস বা নিম্ন রক্তচাপ হওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া।
শিশুদের মধ্যে উপসর্গগুলো হচ্ছে, দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস হওয়া, খিচুনি হওয়া, চামড়া ফ্যাকাশে হওয়া, অলসতা অনুভব করা, ঘুম থেকে উঠতে অসুবিধা বোধ করা, স্পর্শে ঠাণ্ডা অনুভব করা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খাওয়ানোর অসুবিধা হওয়া, ঘন ঘন বমি হওয়া বা প্রস্রাব কমে যাওয়া। নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সেপ্টিসেমিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারি। [১] পদক্ষেপ গুলোর মধ্যে সর্বোত্তম উপায় হলো সংক্রমণ এড়ানো। [২] নিরাপদ ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, যেমন হাত ধোয়া এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। [৩] অপরিষ্কার পানি পান থেকে বিরত থাকা এবং অস্বাস্থ্যকর টয়লেট পরিহার করা। [৪] উপযুক্ত স্বাস্থ্য কর্মীদের দ্বারা সুপারিশকৃত টিকা গ্রহণ করা। [৫] নবজাতক শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানো। [৬] সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে কার্যকর নিয়ম অনুসরণ করা। [৭] সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য যথাযথভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত।
সেপ্টিসেমিয়ার চিকিৎসা: সেপ্টিসেমিয়ার চিকিৎসা প্রথম দিকে শুরু করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর্মীরা লক্ষণগুলো দেখে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেপ্টিসেমিয়া নির্ণয় করে থাকেন। এরপর সংক্রমণের উৎস অনুযায়ী যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের বা ফাংগাসের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহারের মাধ্যমে (অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের সংবেদনশীলতা পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল নির্ণয় করে) সেপ্টিসেমিয়ার চিকিৎসা দেওয়া অপরিহার্য। এন্টিমাইক্রবিয়াল রেজিস্টেন্সের কারণে সেপ্টিসেমিয়ার চিকিৎসা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যত বেশি জীবাণু এন্টিমাইক্রবিয়াল রেজিস্টেন্স হবে, ততো বেশি লোকের সেপ্টিসেমিয়ার হওয়ার এবং ফলশ্রুতিতে মৃত্যুরঝুঁকি বাড়বে। বি.দ্র :করোনার চার বছরে ৭ মিলিয়ন বা ৭০ লক্ষ মানুষ মারা গেছে সারা পৃথিবীতে। বিভিন্ন গবেষণায় অনুমান করা হচ্ছে এই একই সময়ে ৪০ মিলিয়ন বা ৪ কোটি মানুষ মারা যাবে সেপসিস/ সেপ্টিসেমিয়ার জন্য। লেখক: ক্যারোলিন্সকা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, স্টকহোম, সুইডেন