সুপ্রতিম সরকার : মাস্টারদা কে? ১৯৩০ সালের ১ মে চট্টগ্রামের জেলাশাসক এইচ.আর.উইকিনসন বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে গোপন পত্রে লেখেন, ‘ Revolutionary outbreak in Chittagong during which events occurred which have no parallel in Bengal since the mutinity of 1857. It was a declaration of war against His Magesty the king by a bodz of armed and disciplined men calling themselves the Chittagong branch of the Indian Republic Army. They succeeded in affecting a complete surprise.’
মাস্টারদা কে? চট্টগ্রামের জনসাধারণ বলতো টাকা দিয়ে সূর্য সেনকে ধরা যায় না। তাই তো তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য ব্রিটিশরা হাজার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেও কেউ তাঁকে ধরিয়ে দিতে চায়নি। দিনের পর দিন মাস্টারদা চট্টগ্রামে আত্মগোপন করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে গিয়েছেন। যদিও শেষমেশ নেত্র সেন পুরস্কারের লোভে মাষ্টারদাকে ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার তিনদিন পরেই নেত্র সেনকে হত্যা করেছিলেন তাদের পরিবারের ছোট ছেলে কিরণ সেন। দীর্ঘদিন পুলিশি জেরার পরেও নেত্র সেনের স্ত্রী মুখে আনেননি কিরণ সেনের নামে।
মাস্টারদা কে? সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করেÑ তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
মাস্টারদা কে? ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাস । জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধের পর মাস্টারদা গেরিলা পদ্ধতিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় কলকাতা থেকে সুভাষচন্দ্রের দাদা প্রখ্যাত ব্যারিস্টার শরৎ বোস বিপ্লবীদের পক্ষে মামলা পরিচালন করতে ছুটে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। শরৎ বোস মাস্টারদার কাছে গিয়ে বললেন যে, তিনি মাস্টারদাকে এমন জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারেন যেখানে তিনি ইংরেজদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারেন। জবাবে মাস্টারদা বললেন, চট্টগ্রাম তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়তে পারবেন না। যেসব বিপ্লবীরা তার নির্দেশে জালালাবাদ পাহাড়ে, কালার পোলে লড়াই করে যাচ্ছে, যারা জেলে বন্দি হয়ে ইংরেজদের কাছে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করছে, তারা সকলে অপেক্ষা করছে মাস্টারদা কী করে তা দেখবার জন্য। তিনি চিরবিদ্রোহী, বিপ্লব তার রক্তে। দেশের জন্যে তিনি প্রাণ দিতে পারেন, কিন্তু চট্টগ্রাম তিনি ছাড়তে পারবেন না।
মাস্টারদা কে? ১৯৩৪ সালের ১১ জানুয়ারি কারাগারে অন্তিম রাত্রের শেষ বাণীতেও আপনি দিয়ে গেছেন, আপনার সাধন-ধন ভবিষ্যতের রূপরেখা। ‘What shall I leave for you? Only one thing, that is my dream, a golden dream – a dream of free India. How auspicious a moment it was, when I first saw it! Throughout my life most passionately and untiringly, I have pursued it like a lunatic.’
মাস্টারদা কে? মাস্টারদা তিনি যিনি প্রথম বুঝেছিলেন দেশের মেয়েরাও স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে । মাস্টারদাকে প্রীতিলতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘মেয়েদের আপনারা দলে নিতে চাইতেন না কেন দাদা? তাঁরা কি দেশসেবার যোগ্য নন?’’ মাস্টারদা জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘না, দেশসেবার কঠিন কর্তব্য থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা চলে না। দেশসেবায় নরনারী ভেদ নেই।’ মাস্টারদা কে? অদ্ভুত ভালোবাসতেন মাস্টারদা দলের সকলকে । বলতেন, ‘কৃপণতায় পয়সা বাঁচানো যেতে পারে, কিন্তু আমাকে বাঁচাতে হবে আমাদের ছেলেদের ।’ কোনো ছেলেকে কাজে পাঠানোর সময় তার না ফেরা অবধি অস্থির হয়ে থাকতেন মাস্টারদা। বলতেন, ‘ছেলেরাই আমাকে বড় করেছে।’ দেশবাসী বলতো ‘এক সূর্য সেন থাকলে হাজার হাজার অনন্ত সিংহ, গনেশ ঘোষ বেরোবে।’
মাস্টারদা কে? মাস্টারদা সেই মানুষ যিনি ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি হয় মাস্টারদা সূর্য সেনের। বলা ভালো তাঁর অচেতন দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার আগে বন্দি অবস্থায় সূর্য সেনের উপরে অকথ্য অত্যাচার করা হয় । হাতুড়ি মেরে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল সব দাঁত। উপড়ে নেওয়া হয়েছিল প্রত্যেকটা নখ। তারপর চোখ খুবলে নেয়। মেরে মেরে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল দেহের সব জয়েন্ট । ফাঁসির পর কোনও শেষকৃত্যও হয়নি । ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার ‘ঞযব জবহড়হি’ এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয় । ব্রিটিশদের কতটা প্রতিশোধস্পৃহা থাকলে এটা করা সম্ভব!
মাস্টারদা কে? মাস্টারদার নেতৃত্বেই চট্টগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘চট্টগ্রাম স্বাধীন জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়। হতে পারে তিন/চার দিনের জন্য, তবু মাস্টারদারা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বিস্ময়ে থমকে গিয়েছিল ভারতবর্ষ। রক্তে দোলা দিয়েছিলো। হ্যাঁ, আমরাও পারি। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি হয়েছিল মাস্টারদার। বিক্ষত সোনালী স্বপ্নের সেই পাথর বুকে নিয়ে বঙ্গোপসাগরের তলায় ঘুমিয়ে আছেন সূর্য সেন। সে প্রস্তরের উপর গড়ে উঠেছে স্বাধীন ভারতের ভিত্তি। ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম/হাসি মুখে তাঁরা ফাঁসিকাঠে ঝোলে/মুখে ঢালে বিষ শিশি/বিদেশি যা কিছু ধূলায় উড়িয়ে/প্রচলন করে দেশি/লক্ষ্য যাদের দেশের মুক্তি/নিজের জীবন তুচ্ছ/আজ পতাকার বুক থেকে ঝরে/তাঁর নামে ফুলগুচ্ছ/আত্মবলিদান দিবসে বিনম্র প্রণাম ।
অহর্নিশ : আইপিএস সুপ্রতিম সরকার বাংলার বিপ্লবীদের নিয়ে এই তথ্যসমৃদ্ধ সিরিজটি লিখেছেন কলকাতা পুলিশের সংগ্রহশালায় মজুত নথি থেকে, যত্নবান গবেষণা করে। কাহিনিগুলো থেকে বোঝা যায়, ভারতবাসী যাতে নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে তার জন্য কী অপরিসীম ত্যাগস্বীকার করেছিলেন তরুণ বিপ্লবীরা। আমাদের মনে হয়েছিলো, এই মহাপ্রাণ বিপ্লবীদের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম জানানোর একটি উপায় হলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁদের ত্যাগের কাহিনি পৌঁছে দেওয়া। পড়তেই হবে আইপিএস সুপ্রতিম সরকার মহাশয়ের ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে অচেনা লালবাজার’। এই বই সংগ্রহে রাখার মতো বই। আমাজন লিংক :https://amzn.to/3oRIbsm। অহর্নিশের ফেসবুক পেজে ১২-১-২৪ প্রকাশিত হয়েছে।