শিরোনাম
◈ স্যার পাঁচ বছর, স্যার পাঁচ বছর’ ◈ ট্রাম্পের সঙ্গে বাবার বিরোধ নিয়ে যা বললেন ইলন মাস্ক-কন্যা ◈ ঢাকায় কোরবানির মাংসের অস্থায়ী বাজার: ২০০-৭৫০ টাকায় মিলে ১ কেজি গরুর মাংস ◈ বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বাজারে ভারতের গার্মেন্টস আগ্রাসন! ◈ ফ্রিজে মাংস সংরক্ষণ: টিপস, তাপমাত্রা ও সতর্কতা ◈ রাজধানীতে কোরবানির সময় গরুর লাথি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত শতাধিক ◈ শহরের ঈদ আনন্দে বর্জ্যের গন্ধ থাকবে না — স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ◈ কোরবানির পশুর বর্জ্য ১২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করাই এবার বড় চ্যালেঞ্জ ◈ এপ্রিল মাস জাতীয় নির্বাচনের জন্য উপযোগী নয়: মির্জা ফখরুল (ভিডিও) ◈ কোরবানির মৌসুমে ঢাকামুখী দুই হাজার দিনাজপুরের কসাই, জনপ্রতি লক্ষাধিক টাকার আয় লক্ষ্যমাত্রা

প্রকাশিত : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৭:৩১ সকাল
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৮:৫০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

হয়রত নূহ (আ.) এর ‘তরী’   

সিরাজ ইসলাম

সিরাজ ইসলাম: নূহ নবীর যামানা সুদূর অতীতের কথা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসে কতো ভাঙ্গাগড়া গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে বিশেষ উন্নয়ন হয়েছে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে। এছাড়া সেযুগে জলপথে এখনকার মতো আইনের কড়াকড়ি ছিলো না। তখন যেকেউ যেমনতেমন একটা নৌকা বানিয়ে যেদিকে খুশি রওনা দিতে পারতো। ধার ধারতে হতো না কর্তৃপক্ষের। এযুগে পরিস্থিতি ভিন্ন। বহু হাজার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জীবন সম্পর্কে অধিকতর সতর্ক হতে শিখেছি। শিখেছি আরো ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে। নূহ সেসময়ে যে বেপরোয়া কাজটা করেছিলেন, তা এখন করার অনুমতিই পেতেন না। কল্পনা করা যাক জার্মানির সমুদ্রবন্দর ব্রেমেন থেকে নূহ জাহাজ ভাসাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁকে দেখে এগিয়ে এসেছেন জার্মান ঝানু ইন্সপেক্টর। জাহাজের খুঁটিনাটি তিনি পরীক্ষা করে দেখছেন। প্রত্যেক পর্যায়ে যতদূর আপত্তি তোলা সম্ভব, তুলছেন। জার্মানির সমুদ্রবন্দর ও নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে আপনার যদি কিছুটাও ধারণা থাকে, তবে নূহের সাথে কোম্পানির ইন্সপেক্টরের বাৎচিতের দৃশ্যটা অনুমান করতে পারবেন। জমকালো সামরিক পোশাকে সজ্জিত ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক প্রথমে মার্জিত হেসে নূহের দিকে এগিয়ে আসবেন। আইনের প্রশ্নে তিনি অনমনীয় এবং কর্তব্য পালনে ধ্রুবতারার মতো অটল। তবু আচরণে কোথাও ভদ্রতার কিছুমাত্র কমতি নেই। তিনি নূহকে জিজ্ঞেস করবেন নামধাম পিতৃপরিচয়। কাগজে টুকে নেবেন জন্মের স্থান ও তারিখ।

সেইসাথে নাগরিকত্ব, বৈবাহিক অবস্থা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, প্রতিষ্ঠানের বিবরণ, আয়করের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা ও ধর্মবিশ্বাস। এছাড়া বউ, ছেলেমেয়ে ও কর্মচারীদের নাম, তাদের লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদি। এরপর দরকার হবে ত্রুটিমুক্ত একটি পাসপোর্ট। নূহের কাছে এখনি সেটা না থাকলে অবশ্যই এক দৌড়ে বাড়ি গিয়ে তা নিয়ে আসতে হবে। তাতে সিল থাকতে হবে এক্সিট ভিসার। ছাড়পত্র ঘটিত সমস্ত ঝামেলা মিটে যাওয়ার পরেই কেবল জাহাজের প্রসঙ্গ আসতে পারে, তার আগে নয়। অনুমান করা যায়, তাঁদের আলাপটা এগিয়ে যাবে অনেকটা এভাবে : কেমন লম্বা আপনার জাহাজ? দেড় শ’ মিটার। চওড়া? তেইশ মিটার। গভীরতা? চৌদ্দ মিটার। কিসে তৈরি? কাঠে। যাত্রী সংখ্যা? আট জন। ক’জন পুরুষ, ক’জন নারী? অর্ধেক পুরুষ, অন্যরা মহিলা। তাদের বয়স? এক শ’ থেকে ঊর্ধ্বে। ঊর্ধ্বে কতদূর? ছয় শ’ বছর পর্যন্ত। আচ্ছা, তার মানে জাহাজ শিকাগো যাচ্ছে, সার্জনের নাম? আমাদের কোনো সার্জন নেই। আপনাদের অবশ্যই একজন সার্জন থাকা দরকার। সেইসাথে বিশেষভাবে জরুরি একজন পরিদর্শক। এই বয়সে এই বুড়ো মানুষগুলোকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। নাবিক কতোজন? সেই আটজনই। আটজনই? হ্যাঁ, সেই আটজনই। এবং তাঁদের অর্ধেক আবার নারী? হ্যাঁ, জনাব। আগে তাঁরা কখনো একাজ করেছেন? না, জনাব। পুরুষরা? জ্বি না। আপনারা কেউ আগে কখনো সমুদ্রে ছিলেন? জ্বি না। অন্যরা এখন কোথায়? একটা খামারে সবাই অপেক্ষা করছে। এধরণের একটা জাহাজে অবশ্যই কমপক্ষে আট শ’ নাবিক থাকা প্রয়োজন। এতে অন্তত চারজন চাপরাসি ও নয়জন রাঁধুনি থাকতে হবে। কাপ্তান কে? আমি, জনাব। আপনাদের একজন কাপ্তান জোগাড় করতে হবে। সাথে একজন চেম্বার-পরিচারক। কিছু সেবিকা থাকতে হবে এই বুড়ো মানুষগুলোকে দেখাশোনার জন্য। জাহাজটা কে বানিয়েছে? আমি, জনাব। আপনার কি এটা প্রথম উদ্যোগ? জ্বি জনাব। আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। মালপত্র? জীব-জানোয়ার। প্রকার? সর্ব প্রকারের। গৃহপালিত, না জঙ্গলের? অধিকাংশই জঙ্গলের। হিংস্র, নাকি নিরীহ? প্রধানত হিংস্র।

যেমন? যেমন সিংহ, বাঘ, নেকড়ে, সাপ, হাতি, জলহস্তী, ভল্লুক, জিরাফ ও গণ্ডার। এছাড়া সব জলবায়ুর সব জাতের পোষা ও বুনো জানোয়ার। জোড়ায় জোড়ায়। সবাই ভালোভাবে খাঁচাবদ্ধ তো? না, একেবারেই খাঁচা ছাড়া। এদের জন্য লোহার শক্ত খাঁচা দরকার। পশুগুলোকে পরিচর্যা কে করবে? আমরাই। এই বৃদ্ধ লোকেরা? জ্বি জনাব। দু’পক্ষের জন্যই তা বিপজ্জনক। পশুদেরকে মজবুত খাঁচায় রাখতে হবে। পর্যাপ্ত খাবার দিতে হবে। এবং এই বৃদ্ধদেরকেও দিতে হবে বিশ্রাম। জন্তু মোট কয়টা? বড় জানোয়ার সাত হাজার। ছোটবড় মিলিয়ে আটানব্বই হাজার। অন্তত বারো শ’ লোক থাকতে হবে এদের দেখাশোনার জন্য। জাহাজটা আলোকিত করবেন কিভাবে? দু’টো জানলা দিয়ে। দেড় শ’ মিটার লম্বা ও তেইশ মিটার চওড়া এতো বড় একটা জাহাজে মাত্র দু’টো জানলা? এতে অন্তত পনেরো শত বাতি থাকা উচিত। জাহাজ ছিদ্র হয়ে গেলে আপনারা পানি সরাবেন কিভাবে? আপনাদের কয়টা পাম্প আছে? একটিও নেই, জনাব। আপনাদের সাথে পাম্প থাকতে হবে। যাত্রী ও জানোয়ারদের জন্য আপনারা পানি কিভাবে সংগ্রহ করবেন? আমরা জানলা দিয়ে বালতি ছেড়ে দেবো। এটা যথেষ্ট না। আপনাদের মোটিভ পাওয়ার কী? আমাদের কী জিনিসের কথা বলছেন? মোটিভ পাওয়ার। জাহাজ চালাতে আপনারা কী জাতীয় পাওয়ার ব্যবহার করেন? কিছুই ব্যবহার করিনা। আপনাদের পাল কিংবা বাষ্প থাকতে হবে। আপনাদের স্টিয়ারিং যন্ত্রের ধরণ কী? আমাদের এ জাতীয় কিছু নেই। আপনাদের রাডার আছে? না, জনাব। একটা রাডার থাকা অত্যন্ত জরুরি। আপনাদের কয়টা নোঙ্গর আছে? একটিও নেই। অন্তত ছয়টা থাকা উচিত।

নোঙ্গর প্রতিরক্ষা ছাড়া এধরণের জাহাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া যায় না। আপনাদের সাথে কয়টা জীবনতরী আছে? আদৌ নেই। অন্তত পঁচিশটা থাকতে হবে। আপনাদের সফর কতোদিনের? এগারো থেকে বারো মাস। এগারো থেকে বারো মাস? বেশ দীর্ঘদিন, আমার ধারণা। আপনাদের জাহাজ কিসে মোড়া? তামায়? আদৌ মোড়া নয়। শ্রদ্ধেয় জনাব, বিরক্ত পশুরা দু’দিনেই কাঠের পাটাতনটুকু ফুটো করে ফেলবে। মুহূর্তে আপনাদের তরীকে ডুবিয়ে দেবে। একে অবশ্যই মুড়তে হবে। ভালো কথা, আপনি জানেন শিকাগো একটা মধ্যস্থল শহর, তাতে জাহাজে করে যাওয়া যায়না। শি-কার্গো? শি-কার্গো কী? আমি শি-কার্গোতে যাচ্ছিনে। তাই? তাহলে জানতে পারি কি, জন্তুগুলো কি জন্য? শুধু বংশবিস্তারে প্রয়োজনে, জনাব। কেবল জীবের ধারা টিকিয়ে রাখার দরকারে। বংশবিস্তার? আরো জীব? কেন, আপনাদের যা আছে তা কি একেবারে কম? আমাদের এই এতো বড় মহতী উদ্যোগ, জনাব, তা শুধুমাত্র সভ্যতার অনুরোধে। হ্যাঁ, ধরাপৃষ্ঠে জীবনের প্রবাহ চালু রাখার উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর অবশিষ্ট জীবকুল এক মহাপ্লাবনে ডুবে যাওয়ার পথে। জাহাজের জন্তুগুলো তাঁদের বংশ বাঁচিয়ে রাখবে, এই আমাদের আশা। প্লাবন? জ্বি জনাব। আপনি কি নিশ্চিত? পুরোপুরি। চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত ধরে মুষলধারায় বৃষ্টি হবে। এ ব্যাপারে চিন্তিত হবেন না, জনাব। এখানে এটা প্রায়ই হয়ে থাকে। কিন্তু এটা সেধরণের বৃষ্টি নয়। তা পর্বতের চূড়া পর্যন্ত ঢেকে ফেলবে। সারা পৃথিবী দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, নিছক ব্যক্তিগতভাবে আমি দু:খিত যে, আপনি এমন একটা গুরুতর পূর্বাভাস জেনে ফেলেছেন। কেননা তাহলে আমি পাল ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারিনে। এক্ষেত্রে অবশ্যই বাষ্প ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া এতোগুলো জীবের এগারো মাসের জন্য প্রয়োজনীয় পানীয় জলের পরিমাণ হবে অন্তত দশ লক্ষ গ্যালন। আপনাদের জাহাজ এই চাহিদার এক শতাংশও বহন করতে পারে না। অথচ আপনাদের সাথে পর্যাপ্ত পানীয় জল থাকতেই হবে। কিন্তু আমি আপনাকে বলেছি, আমরা বালতিতে করে বাইরে থেকে পানি ওঠাব। এটা যথেষ্ট হবে না। প্লাবনের জল পর্বতশিখরে পৌঁছানোর আগেই সাগরের লোনা পানির সাথে মিশে সব লবণাক্ত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে পানি পরিশোধিত করতে হবে। 

এখন আমি আপনাকে বিদায় দেব, জনাব। আশা করি আমি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি যে, আমাদের কিছু প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা আপনাকে ঠিক অনুমতি দিতে পারছিনে, যদিও জাহাজ তৈরিতে আপনার এ উদ্যোগ বেশ প্রশংসনীয়। এ আমার একান্তই প্রথম উদ্যোগ, জনাব। আপনাকে নির্মল অন্ত:করণ থেকে বলছি, আমি এই তরীটি নৌ স্থাপত্যে কোনোপ্রকার পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়াই নির্মাণ করেছি। এটা নি:সন্দেহে একটা প্রশংসার্হ কাজ, জনাব, অতিশয় প্রশংসার্হ। আপনার এ উৎসাহজনক মন্তব্য আমাকে অশেষ সম্মান দিলো। একে আমি আজীবন স্মৃতিপটে অক্ষয় অমলিন করে রাখব। জনাব, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। না, তাই বলে ভুলেও ভাববেন না জার্মান ইন্সপেক্টর বুঝি নূহকে সমুদ্রের পথে ছেড়ে দেবেন। হ্যাঁ, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সৌজন্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যাবেন। ব্যবহারে প্রকাশ করবেন না বিন্দুমাত্রও বিরক্তি। বরং এমন একটা ভাব দেখাবেন যেনো এতোকিছুর পরেও নূহের সাথে আলাপ করে ভীষণ খুশি হয়েছেন তিনি। যেন তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরই একজন। তবু কস্মিনকালেও নূহ চেকিংপোস্ট ডিঙ্গিয়ে জাহাজ ছাড়ার অনুমতি পাবেন না। ফেসবুক থেকে 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়