ড. এমদাদুল হক: প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ কোনো কোনো বৃক্ষকে দেবতা হিসেবে সম্মান করে এসেছে। শীতে পাতা ঝরে পড়া, বর্ষায় সজীব বিস্তার, বসন্তে ফুল-ফলের সমারোহ, গ্রীষ্মে শীতল ছায়া— বৃক্ষের এই জীবনচক্র হয়ত মানুষের মন আন্দোলিত করেছিল। আদিম মানুষের কাছে গাছ ছিল জীবন, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের প্রতীক।
ইব্রাহিমি ধারার শাস্ত্রানুযায়ী নিষিদ্ধ এক বৃক্ষের ফল খেয়ে আদম-হাওয়া জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ গৌতম বোধি লাভ করেছিলেন বোধিবৃক্ষের ছায়াতলে। ইহুদি ধর্মের একটি আধ্যাত্মিক দলের সাধনা পদ্ধতি হলো জীবনবৃক্ষ। তারা বলেন, যারা জীবনবৃক্ষের রহস্য জানতে পেরেছে তারা নিজেকে জানতে পেরেছে।
লাতভিয়ায় মহাজাগতিক বৃক্ষের শাখায় যেসব স্তন্যপায়ী জীব বাস করে বিশ্বাসীদের কাছে তারা প্রবৃত্তি বা নফসের প্রতীক, যেসব পাখিরা প্রশাখায় বাস করে তারা আত্মজ্ঞানের প্রতীক এবং এর শিকড়ে যেসব সাপ বাস করে তারা প্রজ্ঞার প্রতীক। আমাদের পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করত বৃহৎ এক বৃক্ষ থেকে জন্ম নিয়েছে দেবতা এবং মানবজাতি। এখনও কিছু মানুষ সেই বৃক্ষকে খোঁজে এবং কিছু মহাজাগতিক পরিভ্রমণকারী তার দেখা পায়।
সম্ভবত এই বৃক্ষের কথাই বলা হয়েছে মৎস্য পুরাণে—
“একটি পুকুর দশটি কূপের সমান
দশটি পুকুর একটি হ্রদের সমান
দশটি হ্রদ এক পুত্রের সমান
দশ পুত্র একটি গাছের সমান”।
গাছ থেকে মানুষের জন্ম। সন্তান তো মাতাপিতার মতোই হবে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলছে: “বাস্তবেই মানুষ গাছের মতো। মানুষের চুল গাছের পাতার মতো, মানুষের চামড়া গাছের ছালের মতো। মানুষের রক্ত গাছের রস, কষের মতো। মানুষের মাংস গাছের কাঠের মতো। মানুষের হাড় কাঠের সারের মতো। মানুষের মজ্জা গাছের পিথের মতো“।
সন্দেহ নেই প্রথমে গাছ, এরপর মানুষ। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে-“ আমার প্রিয় পুত্র, এই সূক্ষ্ম নির্যাস যা তুমি চোখে দেখতে পাচ্ছ না, তা থেকেই উৎপন্ন হয়েছে বিশাল বটগাছ...এবং এই নির্যাস স্বয়ং গঠন করেছে সমগ্র বিশ্ব” ।
গাছের যে সংবেদনশীলতা আছে তা তো আমরা সামান্য লজ্জাবতী গাছ দেখেই বুঝতে পারি। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বললেন, ‘গাছের প্রাণ আছে’। তার মানে আঘাত পেলে গাছ কাঁদে, আদর পেলে আনন্দে হাসে।
চার্লস ডারউইন বললেন, ‘গাছের প্রাণ যেহেতু আছে মস্তিষ্কও আছে’। গাছের যদি মস্তিষ্ক না থাকত তবে ডালা কাটলে বা পাতা ছিঁড়লে রক্তের মতো কষ পড়া বন্ধ হতো না।
মস্তিষ্ক যেহেতু আছে মনও আছে। মন যেহেতু আছে মনের কথাও আছে। গাছের মনের কথা লুকিয়ে থাকে তার মস্তিষ্কে। গাছের মস্তিষ্ক কোথায় থাকে? ডারউইন বললেন, ‘বীজ থেকে প্রথম যে শিকড়টি বের হয় তারই ডগায় থাকে গাছের মস্তিষ্ক’।
আধুনিক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা একমত যে, গাছ পরিবেশ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং সংকেতের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারে। এমনকি কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে সাড়া দিতে হবে সে বিষয়ে পূর্ব-পরিকল্পনা করতে পারে। নিজ সিদ্ধান্তের ভুল-শুদ্ধ বিশ্লেষণ এবং স্মৃতি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও রয়েছে গাছের।
এরিষ্টটল বিশ্বাস করতেন গাছের আত্মা আছে। তিনি কি ছান্দোগ্য উপনিষদ পড়েছিলেন?
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে, “ কেউ যদি এই বিরাট গাছটির মূলে আঘাত করে তবে রক্ত ঝরবে কিন্তু গাছটি বেঁচে থাকবে, কেউ যদি এর মাঝখানে আঘাত করে তবে রক্ত ঝরবে কিন্তু গাছটি বেঁচে থাকবে, কেউ যদি এর শীর্ষে আঘাত করে তবে রক্ত ঝরবে কিন্তু গাছটি বেঁচে থাকবে। আত্মা দ্বারা পরিব্যাপ্ত হওয়ায় এটি জীবনের রস পান করতে দাঁড়িয়ে থাকে। আত্মা যদি তাকে ছেড়ে যায় তবেই সে শুকিয়ে যায়“।
উপনিষদ জুড়ে গাছ, মানুষ ও ঈশ্বর একসূত্রে গাঁথা।
মানুষ যদি ঈশ্বরকে পেতে চায় তবে গাছের কাছে যেতে হয়। বানপ্রস্থ অর্থ ‘বনে অবসর গ্রহণ’। উত্তরাধিকারীর কাছে সংসারের দায়িত্ব অর্পণ করে সাধকের অনুপ্রবেশ ঘটে বানপ্রস্থ জীবনে। (চলবে)। ফেসবুক