জাকির তালুকদার: অনেকেই জানেন, ‘আনা কারেনিনা’ প্রকাশের পর তলস্তয় অনেক বছরের জন্য লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিলো সবচাইতে বড় কাজ হচ্ছে ‘সত্যভাবে বাঁচা’। সেটি কী? তারচেয়ে বলা সহজ কেন তলস্তয় নিজের বা দেশের মানুষের জীবন যাপনকে মিথ্যা মনে করছিলেন। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, মানুষ নিজের জীবনকে অর্থবহ করার জন্য যা যা করছে, সেগুলো আসলে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা। গাড়ি, বাড়ি, ঠাট-বাট, প্রেম, সংসার, পরকিয়া, এমনকি শিল্পসৃষ্টিও করছে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্যই। ‘সত্যভাবে বাঁচা’র জন্য নিজের পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছিলেন তলস্তয়। অভিজাত সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলেন, চাষিদের মতো পোশাক পরতে শুরু করলেন, নিজেই চাষিদের সঙ্গে কাজে নেমে গেলেন ফসলের মাঠে, চাষির সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে শুরু করলেন, নিজেই লিখলেন তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক।
ওদিকে হাহাকার পড়ে গেছে। তলস্তয় আর লিখছেন না। সারা রাশিয়ায় গেলো গেলো রব। স্বয়ং জার তলস্তয়ের স্ত্রীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন- তলস্তয়ের নতুন লেখা ছাড়া রাশিয়া পথ হারাবে। এই ‘পথ’টিকেও সঠিক মনে করতেন না তলস্তয়। যে পথে রাশিয়া হাঁটছে, সেই পথ রুশজাতিকে আত্মহননের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিজে অহিংসায় বিশ্বাসী। কিন্তু অনুভব করছেন বিপ্লব না ঘটলে মানুষ ‘সত্যভাবে বাঁচা’র সুযোগ পাবে না। আমাদের গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের শিক্ষাটি তলস্তয়ের কাছ থেকেই পাওয়া। তবে গান্ধী সর্বাংশে বিপ্লববিরোধী। তলস্তয়ের কাছে চিঠি লিখছেন। সেই চিঠির উত্তর পাচ্ছেন ছয় মাস পরে। তলস্তয় সেখানেও ‘সত্যভাবে বাঁচা’র কথাই বলছেন। আমি তলস্তয়ের পায়ের নখের যোগ্য নই। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি আমরা কেউ ‘সত্যভাবে বাঁচা’ জানি না। যারা জাতিকে পরিচালনা করে তারা ‘সত্যভাবে বাঁচা’র ধারণাটির সঙ্গেই পরিচিত নয়। আমিও হয়তো লিখছি নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্যই। হয়তো সেজন্যই লেখা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছা জাগে মাঝে মাঝে। তবে আমি তো তলস্তয় নই। অতখানি মানসিক জোর নেই। লেখক : কথাসাহিত্যিক। ফেসবুকে ৮-১২-২৩ প্রকাশিত হয়েছে।