খালিদ খলিল : বালতিতে জল তোলার প্রসঙ্গ আসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজার বছরের আবহমান বাঙালির পানীয় জলের উৎস পাতকুয়ার ছবি। বাঁশের কোঠায় ঝুলানো লম্বা রশির মাথায় বাঁধা বালতিতে রশি টেনে জল তোলা কারো মূর্ত রূপ। মাটির উপরি স্তর থেকে স্বচ্ছ জলের স্তর পর্যন্ত গভীরে খোড়া গোলাকার কূপÑ এই কূপ থেকেই কুয়া। বাংলায় ‘পাত’ শব্দটি ‘ছোট’ অর্থে ব্যবহার হয়। এই পাত-এর সঙ্গে কুয়া শব্দটি যোগ হয়ে পাতকুয়া শব্দটি এসেছে। ‘পাতকুয়া’র সমার্থক শব্দ ইদারা। এর অপভ্রংশ রূপ ‘ইন্দিরা’। সাধারণত পানীয় জলের উৎস অগভীর কুপই পাতকুয়া। এই অগভীরে খোড়া গোলাকার গর্তের ভেতরে বালি-পাথর ও সিমেন্টের তৈরি কিংবা পোড়া মাটির তৈরি গোলাকার পাট, কখনো বাঁশের তৈরি খাঁচা বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহার হতো। তাই পাতকুয়া কোথাও কোথাও পাটকুয়া, মজার ব্যাপার হলো খুম কম সংখ্যক মানুষের মুখে কুয়া শব্দটি শোনা যেতো। এই কুয়া-কুয়া নয়, ‘চুয়া’ হয়েই উচ্চারিত হতো সর্ব সাধারণের মুখে মুখে।
উপমহাদেশের বাঙালি অধ্যুসিত বাংলার মানুষ কবে থেকে পানযোগ্য পানির জন্য পাতকুয়ার ব্যবহার শুরু করে তার ইতিহাস এখনো প্রচ্ছন্ন। তবে প্রজা হিতৈষী সম্রাট অশোকের সময়ে প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার্থে পাতকুয়া খননের ইতিহাস জানা যায়।
এই পাতকুয়ার ভিতরে পোড়ামাটি কিংবা পাথর বালুর তৈরি পাটের বেষ্টনী দিয়ে তৈরি কুয়া ছিল দুর্লভ। এটা কেবল রাজ-রাজরা কিংবা ধনীক শ্রেণীর মানুষের বাড়িতে দেখা যেতো। পরবর্তীতে মোঘল আমলে মোঘল বাদশাহ্দের পৃষ্টপোষকতায় এবং বাংলার নবাব শেরশাহের আমলে মুফাসির ও পথিকদের জন্য মহাসড়কের পাশে এবং বসত এলাকার পাড়ায় পাড়ায় অধিক সংখ্যক মানুষের জন্য একটি করে পোড়া মাটির বেষ্টনী সমৃদ্ধ কুয়া নির্মিত হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। এর পর প্রাচীন কাল থেকে নিয়ে বিংশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত ব্যবহারের দিক থেকে পাতকুয়ার ইতিহাস, সমৃদ্ধ ইতিহাস। পাটের বেষ্টনী সমৃদ্ধ এ সময়ের পাতকুয়া আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হতো। নিম্ন শ্রেণীর মানুষ সুপেয় পানির জন্য ধনীক শ্রেণীর মানুষের পাটে বেষ্টনী পাতকুয়ার ধারে ভীড় জমাতো। আশির দশকে ডিস্ট্রীক বোর্ডের অধীনে জেলার জনবহুল অঞ্চলে এবং জেলা সদরে পাটের বেষ্টনীর পাতকুয়া বসানো হয়। নব্বই দশকের প্রথম থেকেই নলকূপের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে পাতকুয়ার ব্যবহার কমে আসে, চাপা পড়ে পাতকুয়ার কৌলিন্য।
আজকের তৃতীয় প্রজন্মের কাছে বালতি দিয়ে জলতোলার দৃশ্য নিতান্তই কল্পনা, বাংলায় পাতকুয়ার ব্যবহার শেষ হয়েছে সেই কবে। তবে এখনো স্মৃতি হয়ে, কালের সাক্ষী হিসেবে অব্যাহত পাতকুয়ার সন্ধান পাওয়া যায়। তেমনি একটি পাতকুয়ার সন্ধান পাই রাজশাহীতে। জেলার চারঘাট থানার সারদা’য় ১৯৫৭ সালে স্থাপন করা হয় এটি। কুয়াটি প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৮ সালে স্থাপিত। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে এটি সংস্কার করা হয় মাত্র। তখন কয়েক গ্রামের মানুষ পানি নিতে আসতো। লম্বা লাইন হতো পানির জন্য।