গোলাম মোর্তোজা: বিএনপি ভেঙে যাচ্ছে কিনা, বিএনপি থেকে দলে দলে নেতারা বের হয়ে অন্য কোনো দলে যোগ দিচ্ছেন কিনা, বিএনপি ভেঙে আরেকটি নতুন দল এবং সেই নতুন দলটিতে বিএনপি নেতারা চলে যাচ্ছেন কিনা; এই আলোচনাটি আমাদের রাজনীতিতে এখন খুব প্রকটভাবে আছে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এর বাইরে গত দুই’তিন দিনে বিএনপির যে সমস্ত নেতারা এখনও গ্রেফতার হননি, কিন্তু মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যারা আত্মগোপনে আছেন কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কথা বলছেন সে সমস্ত প্রায় ২০-২২ জন কেন্দ্রীয় থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত নেতাদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ হলো। তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করলাম, বিএনপি ভাঙছে কিনা! বিশেষ করে তৃণমূল বিএনপি বলছে, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যেহেতু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ আছে সে কারণে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জানা যাবে তাদের সঙ্গে কে আসলো। তার মানে আসার প্রক্রিয়া আছে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম।
আমার ধারণা হলো, বিএনপি ভাঙার জন্য একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের তোড়জোড় চলছে। এখানে দুটি উপায়ে বিএনপি ভাঙার চেষ্টা চলছে। একটি হলো যদি তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা হন এবং তার যদি একটি সংসদীয় আসন থাকে, তাহলে সেই কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাকে সংসদীয় একটি আসন দিয়ে তাকে নির্বাচনে আনা সেটা অন্য কোনো একটি দল থেকে। আরেকটি হলো তিনি হয়তো কোনো একটি জায়গা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না, অথবা সেখানে আওয়ামী লীগের বা অন্য দলের শক্তিশালী প্রার্থী আছে, তাদের কাছে প্রস্তাব আছে অর্থের বিনিময়ে। অর্থের বিনিময়ে দল থেকে বের হয়ে এসে অন্য কোনো দলে যোগ দেওয়া এবং নির্বাচন করা অথবা না করা। আরেকটি হলো নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি যদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হন, তাহলে তাকে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী বানানোর একটা প্রস্তাব আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।
আরেকটা প্রস্তাব আছে যদি এমপি নাও হন, তাহলে উপজেলা চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার প্রস্তাব আছে। কারো কারো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাবও আছে, অর্থের প্রস্তাব তো আছেই। তাদের কারো সঙ্গে কথা বলে আমার এমনটা মনে হয়নি তারা এ ধরনের প্রলোভনের প্রস্তাবে বিএনপি ছেড়ে বা বিএনপি ভেঙে আরেকটি দল করছেন বা বিএনপি ভেঙে তিনি বের হয়ে যাচ্ছেন। তার মানে হলো এখন পর্যন্ত বিএনপি ভাঙছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না। বিএনপি সামনের সময়ে ভেঙে যাবে কিনা! সেই আশঙ্কাও খুব কম। বিএনপি ভাঙা বলতে বুঝাচ্ছি গুরুত্বপূর্ণ, কেন্দ্রীয় নেতা, মেইনস্ট্রিমের নেতা, যারা কারাগারে আছেন বা বাইরে আছেন সে রকম কোনো সম্ভাবনা নেই।
এইযে বিএনপি ভাঙলো না বা ভাঙছে না বলে মনে করছি এর কারণটা কী? অন্যান্য কারণের মধ্যে বিএনপি নেতারা যেটা বলছেন, তার মধ্যে একটি কারণ এমন হতে পারে যে আমরা বেগম খালেদা জিয়ার দল করি, জিয়াউর রহমানের দল করি, সেই দল ভেঙে বিপদের দিনে অন্য দলে চলে যাবো এর প্রশ্নই আসে না। এটাকে যদি আমি পরিপূর্ণভাবে সত্য নাও ধরি, তাহলে যারা বিএনপি ভাঙার প্রস্তাব নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে তাদের একটি বড় দুর্বলতা আমার কাছে মনে হয়েছে যে যেসমস্ত মানুষ দিয়ে বিএনএম গঠন করা হয়েছে, যে সমস্ত মানুষদের দিয়ে তৃণমূল বিএনপি গঠন করা হয়েছে, যেমন শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার। শমসের মবিন চৌধুরী জাতীয় পর্যায়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা, সচিব, দলের মন্ত্রী পদমর্যাদায় গুরুত্বপূর্ণভাবে থেকেছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক অবস্থা একেবারেই শূন্য। তার আদর্শিক অবস্থার ব্যাপারে বিএনপি নেতারা বলছেন, তার কোনো আদর্শিক অবস্থা নেই। সুতরাং তার দলে যাওয়া মানে আত্মহত্যা করা। সুতরাং তার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ নেই। যে সমস্ত নেতাদের তৃণমূল বিএনপিতে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে তারা নিজেদের শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় নেতা মনে করেন এবং আসলেও তাই। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের যারা নেতা আছেন সে ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল বা অন্য যে জায়গারই নেতা হোক তারা কেউই তৃণমূল বিএনপি বা বিএনএম-এ গিয়ে নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। এ সমস্ত কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা যদি এখানে যোগ দেন তাহলে শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার দুজনকেই তাদের পদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। মেজর হাফিজকে নিয়ে এমন একটি প্রস্তাব ছিল। কিন্তু মেজর হাফিজ রাজি হননি। তার মানে হলো প্রথমত বিএনপি ভাঙার প্রক্রিয়াগত ভুল ছিল। তার চেয়েও বড় কথা বিএনপি সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিলো এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা দলের প্রতি যে ত্যাগের পরিচয় দিলো, আদর্শিক বিশ্বাসের যে পরিচয় দিলো সেটাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই বিস্মিত হলাম। আমার ধারণা ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা এতোটা আদর্শিক শক্তির পরিচয় দিতে পারবে না, বিএনপিটা ভেঙেই যাবে। কিন্তু বাস্তবে বিএনপি ভাঙলো না।
এই যে বিএনপি ভাঙলো না, এখন বিএনপির কী অবস্থা হবে? বিএনপি কি ক্ষমতায় যাবে? নির্বাচনে যাবে? বিএনপি আরও দুর্বল হয়ে যাবে নাকি আরও শক্তিশালী হবে? প্রথমত নির্বাচনে যাওয়ার মিনিমাম যে পরিবেশ সে পরিবেশটি বিএনপির জন্য রাখা হয়নি। সুতরাং বিশেষ কোনো কিছু যদি হঠাৎ করে না ঘটে যায়, তাহলে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপির অনেক ত্যাগ শিকার করতে হবে। কারণ বিএনপির যে সমস্ত নেতাদের পর্যায়ক্রমে জেল দেওয়া হচ্ছে এই ধকল বিএনপিকে বহুকাল পর্যন্ত সইতে হবে। এটা হলো বিএনপির দুর্বল দিক। আর বিএনপির শক্তির দিক হলো বিএনপিকে যে বলা হতো তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে, তাদের মধ্যে কোনো আদর্শ নেই বিএনপি ক্রমান্বয়ে এই বিষয়টি ভুল প্রমাণ করছে। এই বিষয়টি ভুল প্রমাণ করে বিএনপি নিজেকে সত্যি সত্যি একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত করছে।
এই যে জেল-জরিমানা, দন্ড এসমস্ত জিনিস রাজনীতিতে খুব অস্বাভাবিক জিনিস নয়। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেটা চলছে সেটা অস্বাভাবিক। দুই’একদিন পর পর যেভাবে ৪০-৫০ জন করে সাজা দেওয়া হচ্ছে, এই সাজাগুলো দেওয়ার জন্য রাতের বেলাও আদালত চালু রাখা হয়েছে এগুলো অস্বাভাবিক। অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো এখন একপাক্ষিকভাবে যেভাবে হচ্ছে সেটা আবার উল্টিয়ে যেতে পারে, পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। আমার বিবেচনায় বিএনপি সত্যি সত্যি বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে পারবে। প্রশ্ন থাকেত পারে ক্ষমতায় না গেলে কি শক্তিশালী অবস্থায় থাকতে পারবে? আমার ধারণা পারবে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের গঠনপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ আলাদা। জিয়াউর রহমান সামরিক শাসন থেকে এসে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারা দেশ ঘুরে ঘুরে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। এমন কোনো নিপীড়ন-নির্যাতন নেই যা আওয়ামী লীগকে সহ্য করতে হয়নি। বিএনপিকে এখন সেরকম বা তার চেয়েও বেশি নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সেই নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করে মাঠপর্যায়ে টিকে থেকে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দিলে বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে অথবা নির্বাচনে পরাজিত হলে তখন দলটা কি রকম বিপদে পড়বে সেটা একটা দেখার বিষয় আছে। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ এখন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। বর্তমান সময়ের যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিএনপি ভাঙা, লোভ, ভয় দেখানোর যে সংস্কৃতি দেশে চলছে তার উপর ভিত্তি করে আমার পর্যালোচনা হলো ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি বিলীন হবে না বরং আরও শক্তিশালী ও আদর্শিক একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে। ‘গোলাম মোর্তাজা’ ফেসবুক পেইজের ভিডিও কন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস