শিরোনাম
◈ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সমর্থন অব্যাহত রেখেছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ আওয়ামী লীগের কাছে ৩৫ আসন চায় জাতীয় পার্টি ◈ বৃহস্পতিবার থেকে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত ◈ মহাখালী রয়েল ফিলিং স্টেশনে অগ্নিকাণ্ড, দগ্ধ ৮ ◈ ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যহতি পেলেন ড. ইউনূস ◈ আওয়ামী লীগ এখন লোক ভাগানোর দলে পরিণত হয়েছে: রিজভী ◈ দ্বিতীয় দফায় ২৯টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দিলো ইসি   ◈ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট হবে না, জানালেন জাতীয় পার্টি মহাসচিব চুন্নু ◈ টাইপিংয়ে ভুলের কারণে সংসদে পাস হওয়া শ্রম আইন ফেরত দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি: আইনমন্ত্রী ◈ ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র পেল ইউনেস্কোর স্বীকৃতি

প্রকাশিত : ২২ নভেম্বর, ২০২৩, ০১:৪০ রাত
আপডেট : ২২ নভেম্বর, ২০২৩, ০১:৪১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ক্রিকেট খেলার চেয়ে আমি কেন জ্ঞানচর্চা ভালোবাসি?

কামরুল আহসান

কামরুল আহসান: ছোটবেলায় আমিও ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতাম। ক্লাস নাইনে উঠার পর ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিই। তখন আমি খুব করে গল্পের বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ি। তখনই বুঝতে পারি ক্রিকেট একটা বাজে খেলা। অনেক সময় নষ্ট করে। পুরো একটা বেলা খেয়ে ফেলে। তবু খেলার মধ্যে একটা মজা আছে। কিন্তু, যে মজা আমার চিন্তাচেতনায় স্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলে না তার প্রতি আমি আগ্রহী হতে পারি না। একই তো খেলা প্রতিদিন, হয় হারলাম না-হয় জিতলাম। বিপুল সময় অপচয়ের বিনিময়ে এ মজা আমি নিতে চাই না। খেলা ছেড়ে দিলেও মাঝে মাঝে খেলা দেখতাম। বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পেয়ে যাওয়ায় তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরও খুব জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অপি, বিদুৎ, আশরাফুলরা নায়ক হয়ে যাচ্ছে। নিজের দেশ বড় একটা দলের সাথে খেলছে, এতে নিঃসন্দেহে আনন্দ আছে। কিন্তু, একটানা তিনদিন, চারদিন ধরে হা করে টিভির সামনে বসে টেস্টম্যাচ দেখার সত্যিই কোনো অর্থ হয় না। মাঝে মাঝে একটু-আধটু উঁকি দিয়ে দেখতাম, ফলাফলটা জানতাম, এটুকুই ছিল আমার ক্রিকেটের খবরাখবর রাখা। 

বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের ক্রিকেট দলের খেলাও আমি তেমন দেখি নাই। শচীন টেন্ডুলকারকে আমার নিতান্তই একজন ব্যর্থ মানুষ মনে হতো। একজন মানুষ অপূর্ব একটা জীবন পেলো, সেটা নষ্ট করলো সারাজীবন দৌড়ে! ১০০ টা সেঞ্চুরি দিয়ে সে এখন কী করবে! এ কথা সত্য, খেলা একটা তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। নিজের দেশের জাতীয়তাবাদ তাতে উত্তপ্ত হয়। কিন্তু, শেষ বেলায় নিজের ইগোকে একটু তৃপ্তি দেয়া ছাড়া আর এ আর কী করে! একজন মানুষ কি সারাজীবন ধরে শুধু নিজের ইগোকে পরিতৃপ্ত করে বাঁচতে পারে! তার তো জীবনজগত সম্পর্কে অনেক অনুসন্ধান থাকে। যেহেতু সে মানুষ, তার মধ্যে নিশ্চয়ই এ প্রশ্ন আবির্ভাব হয়, কোত্থেকে সে এলো, কোথায় সে যাবে! নিজের পারিপার্শ্বিক বিশ্বাস দিয়ে সে হয়তো সেটা চালিয়ে নেয়। পাকিস্তানের সব ক্রিকেটাররা তো এখন হুজুর হয়ে গেছে। ইনজামাম, সাঈদ আনোয়ারকে দেখি ওয়াজ করে। কিন্তু, পাকিস্তানে ক্রিকেট এতো জনপ্রিয়তা হওয়া সত্ত্বেও কি পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে? কিংবা, ভারতের? ক্রিকেট কি সত্যিই কোনো জনগোষ্ঠির ওপর সুদূর প্রসারি কোনো প্রভাব ফেলে! পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা কি কখনো ভাবে ভারতের সব খেলোয়াড় হিন্দু কেন, কিংবা, ভারতের খেলোয়াড়রা কি ভাবে পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা সবাই মুসলমান কেন? তারা কেন পরস্পরের শত্রু? 
খেলা হয়তো একটা জনগোষ্ঠিকে সাময়িকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখে। রাষ্ট্রের অনেক ফাঁকফোকর আছে, যার বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ করতে চায়, সচেতন হতে চায়। রাষ্ট্র তখন তাদের নানা জাদুমন্ত্র দেখিয়ে বিবশ করে রাখে। বর্তমান পৃথিবীতে খেলা, এবং এই উপমহাদেশে ক্রিকেট হচ্ছে সেই জাদু। 

খেলা অনেকটা যুদ্ধের বিকল্প হয়েই এসেছে। রক্তপাতহীন এক যুদ্ধ, যার মধ্যে দিয়ে একটা জাতির সম্মান ও বীরত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তার বাইরে খেলা একটা বিশাল বিজ্ঞাপন, পণ্য বিক্রির ইভেন্ট। তার বাইরে এইসব প্রতিযোগিতাপূর্ণ খেলাধূলা একটা রাষ্ট্রের বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে খুব সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। আরো ভালো, যদি বলি পাহারা দিয়ে রাখতে পারে। সময় কাটানোর কোনো মাধ্যম না থাকলে এইসব জনগণ নানা বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। তারা হয়তো রাজনীতি করবে, নাহয় সংস্কৃতি চর্চা করবে, নাহয় ধর্ষণ করবে, মারামারি করবে, নানা অরাজকতা তৈরি করবে। সুতরাং তাদের খোয়ারে ভরে রাখা যাক। 

আধুনিক জামানায় স্টেডিয়ামএকটা আজব খোয়ার। পঞ্চাশ-ষাট হাজার মানুষকে সারাদিনের জন্য মাত্র পঞ্চাশ-ষাটজন পুলিশ দিয়ে গার্ড দিয়ে রাখা যায়। তারও দরকার হয় না। টেলিভিশন আছে। ঘরের ভিতরই বন্দি। ফাঁকে ফাঁকে টেলিভিশন আবার বিজ্ঞাপন দেখায়। কী সেইসব বিজ্ঞাপন? অপ্রয়োজনীয় জিনিশ কিনে পাহাড় জমাও। রঙফর্সাকারি ক্রিম লাগিয়ে ফর্সা হও, মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে, ওই স্যাম্পু লাগাও, প্রেম করার জন্য মোবাইলে ব্যালেন্স ভরো, পেট খারাপ তো ওই সাবান মাখো। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটা বাজার চাঙ্গা রাখা হয়। যা তোমার দরকার নেই, তাও কিনো, না কিনতে পারলে হীনমন্যতা বোধ করো, নিজের ভাগ্যকে দোষারূপ করো, কেন আমি ওর মতো সুন্দর হলাম না, কেন ওর মতো প্রতিষ্ঠিত হলাম না। 

রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে কোনো সেনসেটিভ ইস্যুতে জনগণকে এক করে, সেই একত্রিত হওয়াটা বৃহৎ কোনো মহত্তম উদ্দেশ্যে নয়, বরং আড়ালে রাষ্ট্র তার জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিচ্ছিন্নই রাখে। যে বিচ্ছিন্নতা আজ আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে বড় প্রবলভাবে দৃশ্যমান। রাষ্ট্র শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সুষ্ঠ বিকাশ চায় না। কারণ, তা মানুষকে সচেতন করে, এবং প্রাণের টানেই এক করে। আমাদের রাষ্ট্রে জ্ঞানচর্চা নেই। জ্ঞানচর্চার সমস্ত অবকাঠামো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটমাঠে গিয়ে হাত তালি দিবেন তাতে আর বিচিত্র কী? তিনি আসলে ক্রিকেটের জন্য হাততালি দেন নি, কালেকটিভ কনসাসনেসের পক্ষের মানুষকে খুশি করতে হাত তালি দিয়েছেন। এটা অবচেতনভাবে প্রায় প্রত্যেক অসচেতন মানুষই করে। যেহেতু প্রত্যেকেই নানারকম অপ্রাপ্তি হীনমন্যতাবোধ আছে তাই সে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সঙ্গে একত্রিত হয়ে নিজের শক্তিমত্তাকে বলিয়ান করতে চায়। কিন্তু, সে খেয়াল করে না আড়ালে তার নিজের জীবন বিকিয়ে যাচ্ছে। সে মনে করে সবার সঙ্গে এক হয়ে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। কিন্তু, দেশ প্রেম মানে যে নিজের সমাজ-রাষ্ট্রকে বোধে-মননে-মূল্যবোধে উন্নত করা তা তার চেতনে আসে না।

সত্যি করে বলতে, এই উপমহাদেশে ক্রিকেট এসেছে ধর্মের বিকল্পে। ইংরেজরা শুধু আমাদের ধর্ম দিয়ে আলাদা করে নি, ক্রিকেট দিয়েও আলাদা করে ফেলেছে। ক্রিকেট দিয়ে যদি কিছু হতো তাহলে আজকে ভারত-পাকিস্তানের এ অবস্থা হয় না। আর আমরা যেহেতু ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা, সেহেতু ভারত-পাকিস্তান যেহেতু লাফাচ্ছে তাই আমরাও লাফাচ্ছি। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে নিজেদের ইহকাল-পরকাল ক্রিকেটের হাতে ন্যস্ত করেছি। যেন ক্রিকেটই আমাদের পুলসিরাত পার করে দিবে। মজার ব্যাপার, ক্রিকেট যে-দেশে আবিষ্কার, সেই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া আজ আর এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। মনে হয় খেলার জন্য খেলে। আর আমরা একে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে আছি। কিন্তু, আমি ক্রিকেটের চেয়ে জ্ঞানচর্চা ভালোবাসি এসব রাজনৈতিক কারণে নয়। বরং জ্ঞান একেবারে আমার নিজস্ব সম্পদ। জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই আমি সমগ্র মানবসভ্যতার সঙ্গে এক হতে পারি। মানবসভ্যতা মানে কি, সমগ্র মহাকালের সঙ্গে এক হতে পারি। একমাত্র জ্ঞানের মধ্য দিয়েই আমি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছুতে পারি। যেহেতু আমার জীবন একটা, এবং সে জীবন খুবই সীমিত, আমি যা তা করে আমার অমূল্য সময় অপচয় করতে পারি না। 

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে দুইটা। এক, ক্রিকেট খেলে বা ক্রিকেট খেলা দেখেও তো জ্ঞানচর্চা করা যায়। না, তা যায় না। কারণ, মানুষের আয়ু এতো কম, আর জ্ঞানসমুদ্র এতো বিশাল যে নিরবিচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চা করা ছাড়া আর কোনোকিছু করে সময় নষ্ট করার মতো সময় মানুষের হাতে নেই। মানুষের আয়ু যদি হতো পাঁচশো বছর, তাহলে পাঁচদিন ধরে টেস্টম্যাচ দেখতে বা খেলতে পারতো। ষাট-সত্তর বছরের আয়ু নিয়ে একের পর এক টেস্টম্যাচ খেলা দেখার বা খেলার কোনো অর্থ হয় না। যেহেতু তা চিন্তা- চেতনায় খুব একটা পরিবর্তন আনে না। একমাত্র জ্ঞানই মানুষকে প্রতি মুহূর্তে নতুন করে জন্ম দেয়। একমাত্র জ্ঞানের হাত ধরেই মানুষ অর্জন করতে পারে অমরত্ব। একমাত্র জ্ঞানের রাজ্যেই মানুষের কোনো পরাজয় নেই। যেহেতু সেখানে কোনো জয়ও নেই। 

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা আসতে পারে তা হচ্ছে, প্রত্যেকেরই কি আর জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা আছে? প্রত্যেকেই কি জ্ঞানী হবে? কেউ কেউ তো চায় জীবনটা হেসেখেলে নির্ভার আমোদে কাটিয়ে দিতে। তাদের জন্য আমি বলবো, জীবন কি তারা তা এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। তাদের এখনো মানুষ হিসেবেই জন্ম হয়নি। যদি মানুষ হয়ে জন্ম হতো, তাহলে তারা অবশ্যই নিজের জীবনের অর্থ খুঁজতে সচেষ্ট হতো, তারা ইশ্বরকে খুঁজতো, ঈশ্বরকে না পেয়ে নিজেকে খুঁজতো, নিজেকে খুঁজে না পেয়ে অপরকে খুঁজতো এবং এক সময় আবিষ্কার করতো পুরো জগত একটা আয়না, সেখানে কেবল একে অপরের প্রতিফলন হচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে তারা এক হয়ে ঘোষণা করতো মানবের সর্বময় প্রেম! জ্ঞানের নাম প্রেম, জ্ঞানের নামই জীবন। যেহেতু সমাজে সেই প্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাই আমি বলবো জ্ঞানের রাজ্যে অধিকাংশ মানুষের যাত্রা আরম্ভ হয়নি এবং জ্ঞানবিহীন জীবন অর্থহীন। লেখক ও সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়