শরিফুল হাসান: তিনি বলেছিলেন দেশ স্বাধীন না করে ঘরে বা পরিবারের কাছে ফিরবেন না। তিনি কথা রেখেছিলেন। নিজের ঘর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলতেন তিনি। বলতেন, যে জাতি আত্মসমালোচনা করে না সে জাতি কখনোই অগ্রগতির পথে সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। আরও বলতেন, সরকারের মিথ্যা সাফাই গাওয়া নয়, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরিয়ে দিয়ে দেশ গড়ার কাজে গঠনমূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে। কতোটা বিচক্ষণ হলে এই বাংলায় একজন রাজনীতিবিদ এই কথাগুলো বলার সৎ সাহস রাখেন। বলছি, তাজউদ্দীন আহমদের কথা। মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৮ তম জন্মবার্ষিকী ২৩ জুলাই। আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই বাংলার রাজনীতির জাদুকর। তিনি ছিলেন নেতা। আর তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধান বাস্তবায়নকারী, রাজনীতির দার্শনিক। এমন মেধাবী, আদর্শবান সৎ ও বিচক্ষণ নেতা এই বাংলায় খুব কমই ছিলেন।
ঘরে বাইরে শত প্রতিকূলতার পরেও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে অসাধারণ নেতৃত্ব তিনি দেখিয়েছিলেন সেটি তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিলো বলে মনে করি না। আসলে সার্বক্ষণিক রাজনীতির চর্চার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন। আফসোস তাকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, স্বাধীনতার পর এই দেশটা যদি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন চালাতেন আর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হয়ে মাথার উপরে ছায়া হয়ে থাকতেন সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যেত। এমনকি মোশতাকদের বদলে তাজউদ্দীন আহমেদকে যদি বঙ্গবন্ধু পাশে রাখতেন তাহলেও দেশে এতো বিপর্যয় নেমে আসতো না। তাজউদ্দীন আহমদ গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তিনি জন্ম নেন। ভীষণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৪ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১২ তম স্থান অধিকার করে। স্কুলে থাকতেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন।
ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে যথাসময়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪৮ সালে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। ইন্টারমিডিয়েটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে এমএলএ নির্বাচিত হন। ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পূর্ণ করে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম রাজনৈতিক সহকর্মী হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের বছরই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৭১ সালে প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে স্বাধীন দেশে প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর খুনিরা তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে জেলে হত্যা করে।
আফসোস মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর তাজউদ্দিন আহমদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। কখনোই হয়নি। এমনকি আজও না। বিশ্বাস না হলে আশেপাশে তাকান। তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন আজ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন কী কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করেছে তাকে নিয়ে? রেডিও? কোথাও কোনো আলোচনা সভা আছে? নিদেনপক্ষে ফেসবুকে দলীয় নেতাকর্মীদের পোস্ট? এমনকি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে আজকে এখন পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটা পোস্ট নেই। না কোথাও কিছু নেই। এই বছর নেই। গতবছরও ছিলো না। গত ১৫ বছরেও না। এই দেশে তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে ভালো কোনো তথ্যচিত্র নেই। নেই কোনো সিনেমা। অথচ মোশতাকরা নন, এই তাজউদ্দীনেরাই আসল দেশপ্রেমিক। কিন্তু যেহেতু তারা তোষামোদি করতে পারেন না, তারা ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলনে, ফলে তারা নেতাদের অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আর স্বাধীনতাবিরোধী খন্দকার মোশতাকরা তোষামোদি করে তরতর করে এগিয়ে যায়। এরপর একদিন তারা নেতাকে হত্যা করে। স্বাধীনতার চেতনা লুট করে। আর তাজউদ্দীনরা তখন জীবন দিয়ে প্রমাণ করে তারাই ঠিক ছিলো। এভাবেই রচিত হয় ইতিহাস যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
তাজউদ্দীন আহমদ সবসময় বলতেন, মুছে যাক আমার নাম তবুও বেঁচে থাক বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোয় সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতেন এই বলে, ‘আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি, ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে। তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। ‘তিনি নির্দ্বিধায় বলতেন, ‘মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ। মাঝেমধ্যে মনে হয় তাজউদ্দীন আহমদ কোথাও নেই আবার সবখানেই আছেন। বাংলাদেশের কোষ্টগার্ডের একটা জাহাজের নাম তাজউদ্দীন। বিআইডব্লিউটিসির একটি যাত্রীবাহী জাহাজের নাম তাজউদ্দীন আহমদ। আমার মনে হয়, শত প্রতিকূলতা আর ঝড়ঝঞ্জা উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে যেভাবে সাগরে জাহাজ চলে তাজউদ্দীন আহমদ সেই মানুষ। আজীবন তিনি বেঁচে থাকবেন মাথা উঁচু করে। শুভ জন্মদিন নেতা। আপনাকে স্যালুট। লেখক: কলামিস্ট