জাকির তালুকদার: প্রকাশ্যে কাঁদার অবস্থা তো নেই। অবকাশ নেই। অভ্যাস নেই। তবে আমি প্রকাশ্যে কাঁদতে পারি বিদেশে গেলে। বিশেষ করে কানাডায় গেলে। আরো বিশেষ করে বললে, ভ্যাঙ্কুভারে থাকাকালে। কান্নাটা আসে দেশের জন্য। কাঁদি দেশের সঙ্গে প্রতিতুলনা করে। মানুষ দর্শনীয় জিনিস বা জায়গা দেখতে ছোটে। আমিও গেছি। কিন্তু ভ্যাঙ্কুভার শহরসহ পুরো ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশটাই যে দর্শনীয়। ঘর থেকে বাইরে পা বাড়ালেই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। পার্কগুলো এক-একটা বন। সঙ্গে ঝরনা, লেক, অজস্র পশুপাখি।
আর শহর থেকে বের হলে মনে হয় পুরোটাই ভার্জিন এলাকা। মানুষের পা খুব কম পড়েছে। এত প্রযুক্তি হাতে থাকা সত্ত্বেও ওরা প্রকৃতি নিধন করেনি। প্রকৃতিকে বেশি সাজাতেও যায়নি। রেখে দিয়েছে যতটা সম্ভব স্পর্শ না করে। কাজে লাগিয়েছে পানি সম্পদ। ১৯৭২ সালেও আমাদের দেশে প্রকৃতি ছিল অনেকটাই অক্ষত। ১৯৮০ সাল পর্যন্তও প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যেত সব সদর-মফস্বলে। গ্রামে তো বটেই। দেশের নদনদীগুলো বছরে নয় মাস থাকত নাব্য। যেকোনো স্বাধীন দেশ নিজের সম্পদ কাজে লাগাবেÑ এটাই তো পরিকল্পনা কমিশনের কাজ। কিন্তু স্বাধীনতার পরে কী করল তারা (ঘৃণায় আপনি বলতেও ইচ্ছা করছে না তাদের)। নদীগুলো বুঁজিয়ে ফেললো। রাস্তা বানাও। বিশ্বব্যাংক, জাপান, ফোর্ড কোম্পানি টাকা দিচ্ছে, রাস্তা বানাও। জাপানি-মার্কিন-ভারতীয় গাড়ি চলবে, টায়ার চলবে, যন্ত্রাংশ চলবে। তাই রাস্তা বানাও। নদীর স্রোতধারার দিকে খেয়াল করার দরকার নেই, হাওর-বিলের পানির গতিপথের দিকে নজর রাখার দরকার নেই, কোথায় বাঁধ দিলে সর্বনাশ হবে নদীর সেদিকে খেয়াল রাখার দরকার নেইÑ বানাও, রাস্তা বানাও। আর দালান বানাও। গাছপালা কেটে, মঙ্গলময় জঙ্গলগুলো ধ্বংস করে, ছোট ছোট বুনোপ্রাণী-পাখি-পতঙ্গের আবাস ধ্বংস করে দালান বানাও।
ঘৃণায় কাঁদি, দুঃখে কাঁদি, অসহায়তায় কাঁদি। তবু ফিরে আসি এই দুখি জননীর কাছেই। তার প্রতি অন্যায়ের কোনো প্রতিবিধান করতে পারি না। কোনো পরিবর্তন আনতে পারি না শাসকশ্রেণীর মানসিকতায়। পারি না, এখনো যেটুকু আছে, সেটুকু রক্ষা করতে। পারি শুধু জননীর সঙ্গে, ভ্রাতা-ভগ্নিদের সাথে একসঙ্গে দুঃখভোগ করতে। তার জন্যই ফিরে আসি। লেখক: কথাসাহিত্যিক