ডা. মনিরুজ্জামান: এবারের রমজান হোক আমাদের শ্রেষ্ঠ রমজান। কেন? এর আগেও তো আমাদের প্রত্যেকের জীবনে রমজান পার করেছি বা প্রতি বছরই এসেছে। আমরা যদি খেয়াল করি রজমান ঠিকই আসে আবার চলে যায়, কিন্তু আমরা কাজে লাগাতে পারি না। আমরা এই রমজানকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারি না বা কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়ে থাকি। আমরা খেয়াল করলেই দেখতে পাই, রমজানের আগেও আমাদের যে ওজন থাকে রমজানের পরও একই, রমজানের পূর্বেও আমরা অসুস্থ থাকতামÑ রমজানের পরেও আমরা অসুস্থ থাকি। বিজ্ঞানিরা বলছেন, রমজানের আগে ও পরে যদি আমাদের কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে রমজান মাসের প্রকৃত উপকার আমরা নিতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এবারের রমজান হোক আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ রমজান।
রমজানের মূল ইবাদত হলো রোজা। এই রোজা ইসলামের ভিত্তির পাঁচটির একটি। রোজা ফারসি শব্দ, এটির আরবি শব্দ সিয়াম। সিয়াম, সওম শব্দের বহুবচন। সওম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। এখানে দুই ধরনের বিষয় হতে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে, [১] সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় সকল প্রকার খাবার খাওয়া হতে এবং স্ত্রীসহবাস হতে বিরত থাকতে হবে। [২] সকল ধরনের মিথ্যা, গীবত, পরনিন্দা, জুলুম, অন্যায় এমন যতো ধরনের অপকর্ম আছে তা হতে বিরত থাকা। এই দুটি বিষয় হতে যখন আমরা নিজেদের বিরত রাখতে পারবো তখনই আমাদের এই সওম পালনের লক্ষ্য পূরণ হবে। রমজান শব্দের অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া/পুড়িয়ে দেওয়া। এখানে পুড়িয়ে দেওয়া বলতে নিজের নফসকে পুড়িয়ে খাঁটি করতে বলা হয়েছে। ইসলামি গবেষকেরা বলছেন, আমাদের নফস প্রধানত ৩ প্রকারÑ নফসে আম্মারা, নফসে লাওয়ামা ও নফসে মুতমাইন্না।
আমরা প্রতিনিয়ত অখাদ্য কুখাদ্য বা বাড়তি খাবার খেয়ে আমাদের শরীরের সঙ্গে জুলুম করে চলেছি। ফলাফল হিসেবে পাচ্ছি অসুস্থতা আর নানান রোগ। উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু করে ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ লেগেই আছে। এর অর্থ আমাদের নফস আম্মারা বা লাওয়ামাতে ওঠানামা করছে। নফস আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু আমরা আমাদের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আর এই নফসকেই পরিবর্তন করার সময় হচ্ছে রমজান মাস। আমরা সকলেই জানি রমজান হচ্ছে আত্মশুদ্ধির মাস। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বসূরিদের ওপর, যাতে তোমরা আল্লাহ-সচেতন থাকতে পারো। তবে রোজা রাখা তোমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি কল্যাণের, যদি তোমরা জানতে’। [সূরা বাকারা: আয়াত ১৮৩-১৮৪]।
রোজা রাখার মাধ্যমে শুধু পরকালেই না ইহকালেও আমাদের উপকারের কথা মহান আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন। নবীজী (স) বলেছেন, ‘রোজা রাখো, যাতে তোমরা সুস্থ থাকতে পারো’ [আবু হুরায়রা (রা): তাবারানী]। তারমানে রমজানের ৩০টি রোজা এমন এক ট্রেনিং যার মধ্যদিয়ে আপনি সুস্থতা লাভ করবেন। অন্য হাদিসে নবীজী বলেছেন, ‘সবকিছুর জন্যেই যাকাত (শুদ্ধি প্রক্রিয়া) রয়েছে। শরীরের যাকাত হচ্ছে রোজা’। [আবু হুরায়রা (রা): ইবনে মাজাহ] । এরপরও যদি দেখা যায় আপনি ৩০টি রোজা থেকেও আপনার ওজন কমেনি বা রোগ আছেই, তাহলে বুঝতে হবে আপনি সঠিকভাবে রোজাকে কাজে লাগাতে পারেননি। ১৯৯৪ সালে মরোক্কতে সারা বিশ্ব হতে বিজ্ঞানীরা সম্মিলিত হয়ে একটি সম্মেলন করেন। অনুষ্ঠানটির নাম ছিলো, ‘স্বাস্থ্য এবং রমজান’। এখানে ৫০টির বেশি গবেষণাপত্র তারা উপস্থাপন করেন। এই সেমিনারে রমজানে রোজা ৩০টির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। তারা আমাদের শরীরকে একটি মেশিনের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, একটি মেশিনকে ভালোভাবে কাজ করতে হলে মাঝে মধ্যে যেমন বিশ্রাম প্রয়োজন তেমনি মানব শরীরকে সারা বছর সুস্থ, স্বাভাবিক রাখতে বিশ্রামের প্রয়োজন। একটি মেশিন থেকে সারা বছর পূর্ণ মাত্রায় সার্ভিস পেতে অবশ্যই মেশিককে ১ মাস হলেও বিশ্রামে রাখতে হবে।
আমাদের শরীরও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা গঠিত। এগুলো প্রত্যেকটি অঙ্গই সারা বছরই কোনো না কোনো কাজ করতেই থাকে। তাই আমাদের শরীরকে যদি আমরা এই ১ মাস বিশ্রাম দিতে চাই, তার জন্য সবথেকে উপকারী উপায় রোজা রাখা। তাহলেই আমাদের অঙ্গ গুলো বিশ্রাম পেয়ে পুনরায় ঠিকভাবে কাজ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সঠিক পদ্ধতিতে রোজা রাখতে পারলে অবশ্যই আপনার শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমবে। ফলে আপনি স্মার্ট এবং স্লিম মানুষে পরিণত হবেন। কিন্তু রমজান মাস পরও যদি আপনার বাড়তি ওজন থেকেই যায়, তাহলে এটি পরিষ্কার আপনি সঠিক পদ্ধতিতে রোজা রাখতে ব্যর্থ। আমেরিকার সরকারি সংস্থা এনআইএইস-এর একজন নিউরো সাইন্টিস্ট ডা. মার্ক মাটসন এবং তার দল গবেষণার মাধ্যমে জানান, কেউ যদি মাঝে মাঝে খাবার গ্রহণ হতে কিছু সময় বিরত থাকে তাহলে তার ব্রেন সতেজ থাকবে, তার পাকস্থলি ঠিকমতো কাজ করবে এবং বৃদ্ধ বয়সে অনেকগুলো রোগ থেকে মুক্তি পাবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় বৃদ্ধ বয়সে মানুষের স্মৃতিশক্তি কমে আসে এমন ধরনের কিছু রোগ বাসা বাধে। রোজা রাখলে এই রোগগুলো হতে রক্ষা পাওয়া যায়। আমাদের রক্তে বিভিন্ন পরিমাণ ক্ষতিকর পদার্থ থাকে। এই রক্ত বা কোষের সব থেকে বড় পরিশোধক হচ্ছে রোজা। আমাদের শরীরে ৩০ ট্রিলিয়ন সেল বা কোষ আছে। এগুলোর ভিতরে নানান প্রকার প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি হতে থাকে। এসময় বিভিন্ন বর্জ বা ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হয়। এগুলো পরিশোধনেরও বড় উপায় হচ্ছে রোজা রাখা, যা গবেষণায় প্রমাণিত। একটি গবেষণাতে দেখা গিয়েছে কেউ যদি টাইপ-টু ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পেতে চায়, তাহলে তাকে সপ্তাহে ৩/৪ দিন রোজা রাখতে হবে বা ১৫-২০ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাঝে মাঝে রোজা রাখলে বা উপবাস থাকলে মানুষের আয়ু বেড়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে দেখলে হযরত শাহজালালের আয়ুকাল ছিলো ১৫০ বছর , তিনি মাঝে মাঝেই রোজা রাখতেন আজীবন এবং স্বল্প আহারি ছিলেন। এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে খুঁজলেই। জগৎ বিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনা রোগ নিরাময়ের জন্য সকলকে রোজা রাখার পরমর্শ দিতেন। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন ৩০/৪০ বছর রোজা রেখেও কেন উপকার হচ্ছে না? উত্তর সহজ, আপনার রোজা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মতো করে বা তার পদ্ধতিতে রাখা হচ্ছে না যে কারণে উপরকারটাও তেমন হচ্ছে না। মহানবী (সা.) এর মতো করেই ইফতারি এবং সেহরি করতে হবে তাহলেই আসল ফলাফল পাওয়া যাবে।
সেহরিতে খাবার মেন্যু: সেহরিতে আমরা অতিরিক্ত খাবার খেয়ে থাকি যা একদমই উচিত না। সারাদিন উপবাস থাকতে হবে এই চিন্তা করে আমরা বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু খাবার প্রচুর পরিমাণে খেয়ে থাকি তা উপকারি না হলেও। কিন্তু এটি একটি ভুল পদ্ধতি। সারাদিন ঝরঝরে বা পানির পিপাসা মুক্ত থাকতে হলে প্রথমেই আপনাকে সেহরিতে আমিষ বা প্রোটিন খাওয়া চলবে না। মাছ, মাংস, ডিম এগুলো সেহরিতে বাদ দিতে হবে। তার পরিবর্তে সেহরিতে সামান্য ভাত, সবজি, কলা, খেজুর, টকদই, ভেজা চিড়া এই ধরনের খাবার গ্রহণ করতে হবে সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। এছাড়া সেহরিতে সামান্য কালোজিরা ও রসুন খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। তবে আপনার যদি টাইপ-টু ডায়াবেটিস থাকে তাহলে আপনি রমজানে ১০-১২ দিন সেহরিতে শুধু পানি পান করুন। সম্প্রতি ২টি গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে ৩ দিন ২৪ ঘণ্টার ফাস্টিং বা রোজা মূত্র নিরোধক রিভার্স করতে সক্ষম।
ইফতারে খাবার মেন্যু: ইফতার মানেই আমাদের কাছে মুড়ি, চানাচুর, চপ, বেগুনী বা ভাজাপোড়া হয়ে উঠেছে। এগুলো সবই তেলযুক্ত খাদ্য যা শরীরের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। এজন্য এসব ধরনের খাবার ইফতারে বর্জন করতে হবে। ইফতারে কয়েক প্রকার ফল রাখতে হব্।ে বিশেষ করে খেজুর রাখতে হবে। তাছাড়া হালকা শরবত বা কয়েক গ্লাস পানি ইফতারে পান করতে হবে, এতে পাকস্থলি ঠান্ডা হবে। ইফতারে উৎকৃষ্ট খাবার খেজুর হবার কারণ হলো, খেজুরে সুক্রোজ রয়েছে। এটি চিবিয়ে খাবার পরে সুক্রোজ থেকে গ্লুকোজ+ফ্রুকটোজ তৈরি হয়।
রাতের খাবার: ইফতার পরবর্তি কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে এরপর আমিষ বা প্রোটিন জাতিয় খাবার খাওয়া যাবে। অর্থাৎ মাছ ও মাংস খাওয়া যাবে। রমজানের আগে দুপুরে যে সকল খাবার খেতেন ওগুলোই রমজানে রাতের খাবারের তালিকাতে থাকবে। মাছ, মাংসের সঙ্গে বিভিন্ন সবজি খাওয়া যেতে পারে।
এভাবে যখন কোনো লোক সেহরি ও ইফতার করবে ১ মাস পর তার বাড়তি ওজন এবং চর্বি কমে যাবে। টাইপ-টু ডায়াবেটিস থেকেও পরিত্রাণ পাবে। তাছাড়াও শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে এবং ব্রেইনের কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে। ফলে রমজানের যে মূল লক্ষ্য তা অর্জন হবে। লেখক: কো-অর্ডিনেটর, কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব। সূত্র: ছঁধহঃঁস গবঃযড়ফ ইউটিউব চ্যানেল। অনুলিখন : খসরুল আলম