ইমতিয়াজ মাহমুদ: ‘নটীর পোলা’ কথাটা এমনিতেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোকপ্রিয় গালি। গত কিছুদিন ধরে তো শাহিন আর নটীর পোলা কথাগুলো খুবই আলচিত হচ্ছে আরকি। আপনারাও শুনেছেন, নিশ্চয়ই দেখেছেন ভিডিওটি। আমিও দেখেছি। ভিডিওটা আমি যতবার দেখি ততবারই আমার একটু অস্বস্তি হয় এই নটী কথাটা নিয়ে। এমনিতেই আমি গালি দিই না, যারা কোথায় কোথায় গালি দেয় ওদের এড়িয়ে চলতে চাই। কিন্তু অস্বস্তিটা কেবল গালি নিয়ে নয়। অস্বস্তি হয় যখন আমি দেখি নটীর পোলা বা নটীর ছেলে কথাটার মধ্যে অন্তর্নিহিত মিসোজিনিটা আমাদের বুদ্ধিমান লোকেরা দেখতে পায় না। অথবা হয়তো দেখতে পায়, কিন্তু ওরা এটাকে পছন্দ করে অর্থাৎ নারীবিদ্বেষ ওদের পছন্দ, সেজন্যে বারবার এগুলো বলে। মিসোজিনি এইখানে দুই ধাপে। প্রথম ধাপটা হচ্ছে এইসব গালি সবসময়ই মা তুলে দেওয়া হয়, বাপ তুলে সাধারণত দেওয়া হয় না।
‘পুঙ্গির পুত’ বলে একটা গালি ছিল যেটাকে ধরা হতো বাপ তুলে গালি দেওয়া- এই গালিটা এখন আর খুব একটা চলে না। এছাড়া যখন আমরা কেউ শুয়োরের বাচ্চা বা ওইরকম পশুর সন্তান বলে গালি দেওয়া হয় তখনো গালিটা আসলে নারীকেই দেওয়া হয় অথবা অন্তত নারী পুরুষ দুজনকেই। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বা লোকপ্রিয় যেসব গালি রয়েছে সেগুলো প্রায় সবই নারীকে ধরে গালি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম এলাকায় তো ভয়ঙ্করতম একটা কয়েকটা গালি একরকম সাধারণ বুলি হিসাবেই ব্যবহৃত হয়, লোকে সেগুলোকে গলাই হিসাবেই দেখে না। অন্য কোনো কোনো এলাকায় হয়তো আছে। মিসোজিনির দ্বিতীয় ধাপটা হচ্ছে এইসব গালির প্রায় প্রত্যেকটাই হচ্ছে নারীর চরিত্র নিয়ে।
নটীর পোলা কথাটা যেমন। নটী বলতে সাধারণভাবে আমরা শিল্পী বা পারফর্মিং আর্ট যারা করে ওদের বুঝাই বটে, কিন্তু এইখানে কথাটা হীন অর্থে ব্যবহৃত হয়। হীন অর্থে কেন? নটীর ছেলে বলতে আসলে বুঝানো হয় যে এই ছেলেটির মা প্রমোদ দেওয়ার পেশায় নিয়োজিত এবং সেইভাবেই এই ছেলেটির জন্ম হয়েছে নটীর ছেলে। অর্থাৎ যে নারী প্রমোদ প্রদানের পেশায় থাকে সে অতি হীন চরিত্রের নারী, আর তার পুত্র সেই কারণে একটি মন্দ মানুষ। এটার আরেকটা ইঙ্গিত হচ্ছে যে যারা পারফর্মিং আর্ট করেন, নৃত্য বা অভিনয় এইরকম সব শিল্প করেন সেইসব নারীরা মন্দ। এইসব গালি গতকাল সৃষ্টি হয়নি বা মানুষ নতুন করে আবিষ্কার করেনি।
পৃথিবীতে পিতৃতন্ত্র বহুদিন ধরে বিরাজমান। পিতৃতন্ত্রে নারীর অবস্থান হচ্ছে বস্তুর সমান- ইংরেজিতে যেটাকে বলি আমরা চ্যাটেল। হাড়ি পাতিল বা গরু ছাগল এইরকম। এইটারই একটা অনুষঙ্গ হলো নারীর শরীরের উপর পুরুষের সার্বভৌমত্ব। বিশেষ করে নারী জননেন্দ্রিয়ের উপর পুরুষের সার্বভৌমত্ব। নারীর শরীরের মালিক পুরুষ এবং মালিক হিসাবে পুরুষ নারীকে ব্যবহার করবে, এইটাই নিয়ম। আর একজন নারীর মালিক হবে একজন পুরুষ- একাধিক কখনো নয়।
একজন নারীর জননেন্দ্রিয়ের উপর একজন পুরুষেরই মালিকানা থাকবে। যদি নারী হাতবদল হয়, তাইলে সেই নারী আর অক্ষত যোনি কুমারীর মর্যাদা পাবে না। যে নারী এইরকম মালিকানা বদলে বদলে একাধিক পুরুষের মালিকানায় জীবন কাটায় তার জন্যেও একটা শব্দ আছে বাংলায় ‘বারোভাতারি’। এইগুলো কথা বা এইসব শব্দ তো ভাংলা ভাষায় বহু যুগ ধরে আছে। কীভাবে এসেছে সেইসব ইতিহাস, আপনি খুঁজলে খুঁজে পাবেন। এইসব শব্দের উপস্থিতি আমার অস্বস্তির কারণ নয়। আমার অস্বস্তির কারণ হচ্ছে অন্যত্র।
যেসব বুদ্ধিমান শিক্ষিত বন্ধুকে আমি মহা উল্লাসে নটীর পোলা কথাটাকে নিয়ে ফেসবুকে নানারকম সব পোস্ট দিতে দেখছি গত কয়েকদিন ধরে সেটা আমার অস্বস্তির কারণ। এইসব বন্ধুরা মার্ক্সবাদ জানেন, ফুকো দারিদা হেন কোনো বিদ্যা নাই সেটা ওরা জানেন না। ওদের মনে কি একবারের জন্যেও এই কথাটা জাগে না যে আমার এইসব পোষ্টের মধ্যে কোন না কোনোভাবে এইকটু মিসজিনি তো মিশেই আছে। একবারও কি আমার এইসব বিশাল পণ্ডিত বন্ধুদের কাছে মনে হয় না যে বদলানোর সময় এসেছ? আমি কি সমাজের জ্ঞানী লোকেদের কাছে বেশি প্রত্যাশা করছি? তবে কি সেই কথাটাই সত্যি যে পুরুষ মাত্রই কোনো না কোনোভাবে একেকজন শভিনিস্ট। লেখক: আইনজীবী। ফেসবুক থেকে
