মঈন চৌধুরী: আমি একদিন আমার স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম ‘প্রগতির বিপরীতে প্রতিক্রিয়া থাকবেই। প্রতিক্রিয়াকে প্রগতির পক্ষে আনাই হলো প্রগতিশীলদের কাজ। ‘আমার স্ট্যাটাস পড়ে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘প্রগতি বলতে আপনি কী বোঝেন?’
প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া কিছুটা কঠিন, কারণ আমাদের দেশের অনেক পণ্ডিত শ্রেণীর প্রগতিশীলরাও এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। তারা হয়তো বলতে চাইবেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে সংস্কৃতিমান হওয়াটাই প্রগতিশীলতার লক্ষণ। কিন্তু আমরা বর্তমানে যে সমাজে আছি, সেখানে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ আর ‘সংস্কৃতিমান’ শব্দযুগলের অর্থ বিনির্মিত হয়ে নতুন দ্যোতনা সহ উপস্থিত হয়েছে। এখানে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকার অর্থ হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে কিছু না জানা, আর সংস্কৃতিমান হবার পূর্বশর্ত হল সত্য লুকিয়ে দুর্নীতি করা, শোষক হওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়ে নিজেকে প্রগতিশীল ভাবা, পহেলা বৈশাখে কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়া এবং সম্ভব হলে নাস্তিক হওয়া।
আমরা আমাদের জাতীয়তাবাদ গ্রাহ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জনগনের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোতে প্রগতিশীল চিন্তা সহ যুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখনো আমাদের বেশিরভাগ সহজ সরল জনগন মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে বলে ‘গণ্ডগোলের বছর’ আর জাতীয়তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ভুগছে অস্তিত্বের সংকটে। তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘আমি চাটগাইয়া’, ‘আমি নোয়াখাইলা’,‘আমি ময়মনসিংগা’ কিংবা অন্য কোনো অঞ্চলিক ভূগোল গ্রাহ্য করে। তারা বুঝতে পারছে না তাদের পরিচয় কি শুধু মুসলমান হবে, নাকি বাঙালি মুসলমান হবে, নাকি শুধুই বাঙালি। আমাদের দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আর আদিবাসী সম্প্রদায়ও বাঙালি মৌলবাদের ভয়ে তাদের জাতীয়তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অন্তর্ভূক্ত ধর্মনিরপেক্ষতা হয়ে গেছে অর্থহীন প্রগতিশীল দল কিংবা তাদের পণ্ডিতরা জনগণকে বোঝাতে পারেনি যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আর ‘ধর্মমহীনতা’ এক জিনিস নয়।
সমাজ-সংস্কৃতি বলতে যে ধর্ম, সামাজিক নিয়ম-কানুন, পুজা-পার্বণ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ উৎসব সবই বোঝায়, তা মানতে চায় না প্রগতিশীল গোষ্ঠী। বাংলাদেশের সমাজদর্শনে কোনো কালেই যে নাস্তিকতাবাদ গ্রাহ্য করতো না, এ সত্যকে আমরা বুঝতে চাই না। প্রগতিবাদীরা ধর্মভীরু জনগণকে ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, আর এই ‘প্রগতি/প্রতিক্রিয়া’ যুগ্মবৈপরীত্যকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয় ধর্মবাদী শক্তি। হাটে, ঘাটে, গ্রাম, গঞ্জে তৈরি হয় মাদ্রাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, আর প্রগতিবাদীর দল শহর কেন্দ্রিক মিটিং, সেমিনার, সভা, মঞ্চ, মানব বন্ধন ইত্যাদি করে, গান শুনে আর কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে হয়ে যায় জনগন বিচ্ছিন্ন।
আমি আমার প্রগতিশীলবন্ধুদের বলবো, বাংলাদেশের জনগণকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বুঝে তাদের অস্তিত্বের সংকট থেকে বাঁচান, তাদের বোঝান ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, শোষণমুক্ত সমাজ কি, তাদের বলুন জাতীয়তাবাদ কি ও কেন। তাদের এ কথাও বলুন যে ফরহাদ মজহার কথিত ‘ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে আধিপত্য গত ৫০ বছর আমরা বাংলাদেশে দেখেছি, তার দুর্বলতা ও ক্ষয়ের দিকটাও প্রকট হয়ে উঠল। ইসলাম প্রশ্নের মীমাংসা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হয়ে নানা ভাবে হাজির হতে থাকবে।
ইসলাম প্রশ্নের সঠিক মোকাবেলা না হলে রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতা বাড়বে। ‘এ সব কথা বাঙালি জনগনের জন্য সত্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ বাঙালি বা বঙ্গাল জনগোষ্ঠির মনে বাঙালি জাতিয়তাবাদ (আমি বলি বঙ্গাল জাতিয়তাবাদ) আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই মুখ্য হয়ে থাকার কথা। যদি বাঙালি সব ভুলে গিয়ে থাকে, তবে তা হয়েছে তথাকথিত প্রগতিশীল জনগোষ্ঠির প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ডে। তারপরেও যদি এমন দুর্দিন আমাদের জন্য আসেও, তবে তা প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে থামানো যাবে না, প্রগতিশীল চিন্তা দিয়েই প্রতিক্রিয়াকে থামাতে হবে। ফেসবুক থেকে