মঈন চৌধুরী : যেখানে যেখানে শোভনা গেছেন পেছন পেছন জীবনানন্দ গেছেন। ১৯৩২! ডায়াশেসন কলেজের ছাত্রী শোভনা, কত-ই বা বয়স তখন শোভনার, ১৮’র বেশি তো নয়, জীবনানন্দ ৩৩ বছরের বিবাহিত যুবক। কানা দারোয়ানের হাতে স্লিপ পাঠিয়ে নীচে বসে অপেক্ষা করতেন, কখনও মর্জি হলে শোভনা দেখা করতেন, কখনও করতেন না।
১৯২৯ সাল, ডিব্রুগড়ে ক্লাস নাইনের ছাত্রী শোভনা। বেকার জীবনানন্দ চাকরি খোঁজের বাহানায় সেখানে গিয়েও উপস্থিত। দরজা বন্ধ করে শোভনাকে কবিতা শোনাচ্ছেন। শোভনার মা, জীবনানন্দর কাকিমা, সরযূবালা দাস রাগ করছেন, তবুও।
সবাই মিলে শিকারে গেল, শোভনার বাবা অতুলানন্দ পেশায় ফরেস্টার, আইএফএস, জীবনানন্দ লেখাপড়ার আছিলায় শিকারে গেলেন না, শোভনাও শরীর খারাপের বাহানায় থেকে গেলেন সারা রাত।ডিব্রু নদীর ধারে বলে শহরের নাম ডিব্রুগড়। এই শহরেই এক দিশাহীন ও অনির্দিষ্ট প্রেমে দুজনে জড়িয়ে পড়লেন।
যা সারাজীবন ধরে জীবনানন্দর লিখনে প্রধান চালিকাশক্তির হিসেবে কাজ করবে।
নীচের কবিতাটিও তারই প্রমাণ। আসলে কোনো আড়াল নেই জীবনানন্দর রচনায়। একমাত্র ভালোবাসার আড়াল ছাড়া। বিমূঢ় রক্তের উত্তেজনায় পাখি যেভাবে পাখিনীকে পায় জীবনানন্দ দাশও কি সেভাবেই তাঁর প্রেমিকাকে কামনা করেছিলেন?
‘এইতো সে-দিন ডিব্রু নদীর পাড়ে আমরা ঘুরছিলাম, মনে হয় যেন হাজার বছরের ও-পারে চলে গিয়েছ তুমি শুধু অন্ধকারে বাবলাফুলের গন্ধ যখন পাই কিংবা কখনও-কখনও গভীর রাতে ঘাস মাড়িয়ে তারার আলোয় সেই ব্যথিত ঘাসের শব্দ যখন শুনি রক্তের বিমূঢ় উত্তেজনায় তখন তোমাকে আমি পাখির কাছে পাখিনীর মত পাই।’
শোভনা তখন শিলঙে। কোনো একটা স্কুল বা কলেজে পড়াচ্ছেন। জীবনানন্দ সেখানেও গিয়ে হাজির। ১৯৪৭/৪৮ অবধি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও গল্প উপন্যাসে যে জোয়ার তা আমার মনে হয় অনেকটাই শোভনার জন্য।
সরাসরি শোভনা গল্প উপন্যাস ও কবিতায় জায়গা করে নিচ্ছে।
ভাঙ্গনটা শুরু হয়েছিল আগেই। ১৯৫০ এর পর শোভনা যখন জীবনানন্দর ল্যান্সডাউনের ভাড়া বাড়িতে যাচ্ছেন, তখন ঢুকবার বা বেরোবার সময় একবার মিলুদার ঘরে মুখটা বাড়িয়ে দেখছেন মাত্র। মূল কথাবার্তা বা আড্ডাটা হচ্ছে লাবণ্য বৌদির সাথে।
শোভনা নিজে আমাকে একথা জানিয়েছেন। জীবনানন্দও ১৯৪৮ এর পর আর তেমন লিখছেন কি। এতটাই হতাশ জীবনানন্দ যে বারবার তাঁর ডায়েরিতে ণ তথা বেবি তথা শোভনা-কে হেরোদিয়াসের কন্যা রূপে উল্লেখ করেছেন।
তথ্যসূত্র: গৌতম মিত্র (জীবনানন্দ গবেষক)