আবুল কালাম আজাদ: বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির এক অন্যতম চালিকাশক্তি। তারা দূরত্ব, কষ্ট, একাকীত্ব আর অমানবিক শ্রমঘণ্টা সত্ত্বেও রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অর্থনীতিকেও সচল রাখে। কিন্তু সেই প্রবাসীদের অনেকেই আজ এক ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি—অপহরণ, নির্যাতন, টাকা হাতিয়ে নেওয়া আর মৃত্যুভীতির এক অন্ধকার গহ্বরে তারা প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই করছে। বিশেষ করে সৌদি আরব—যা বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সবচেয়ে বড় গন্তব্য—সেখানকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে রয়েছে এক অদৃশ্য অপহরণ চক্র, যারা নিয়মিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের টার্গেট করছে নির্দয় ও সংগঠিতভাবে।
এই চক্র শুধু অপরাধীই নয়; তারা মানুষের দুর্বলতা, ভিসার জটিলতা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, ভাষা না-জানা, আর আইনি সুরক্ষার অভাবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আর তাদের হাতে বন্দি হয়ে সাধারণ প্রবাসীরা হয়ে উঠছে একেকটি রক্তাক্ত ট্র্যাজেডির চরিত্র, যাদের কণ্ঠস্বর প্রায়ই নিভে যায় মরুভূমির গহিন এক কোণে।
বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যারা যায় — তাদের অধিকাংশই মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে, কিংবা বৈধ কাজের ভিসা পেলেও নির্দিষ্ট কাজ না পেয়ে বিপাকে পড়ে। যখন কেউ কাগজপত্র ঠিকমতো না থাকা বা বৈধ থাকার সমস্যা নিয়ে রাস্তায় বের হয়, তখনই অপহরণকারীরা সুযোগ দেখে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরাই নিজেদের অজান্তে ফেঁসে যায় এমন এক পরিস্থিতিতে যেখানে পরিচিতরূপে উপস্থিত কোনো বাংলাদেশি কিংবা পাকিস্তানি-ইয়েমেনি চক্র তাদের ফাঁদে ফেলে।
অপহরণের একটি সাধারণ কৌশল হলো—রেডিও কিংবা পুলিশের পরিচয় দিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখানো। কিছু সময় তারা আধা-পুলিশি পোশাক পরে, কিংবা স্থানীয় কোনো আরবের সাহায্য নিয়ে নিজেদেরকে আইনের লোক বলে দাবি করে। অসহায় শ্রমিকরা যখন নথিপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়, কিংবা ভয় পেয়ে যায়, তখনই শুরু হয় মূল ষড়যন্ত্র। তাদের জোর করে গাড়িতে তোলা হয়, চোখ বাঁধা হয়, মোবাইল নেওয়া হয়, এবং নিয়ে যাওয়া হয় শহরের বাইরে কোনো নির্জন স্থানে যেখানে একটি ঘর বা গুদামঘরের মতো জায়গা আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। সেখানে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বন্দি রাখা হয়, এবং প্রতিদিন বাংলাদেশে তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে কোটি কোটি টাকা নয়, সাধারণ মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের জন্য অসম্ভব কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে।
অনেক ক্ষেত্রে মারধর, বেঁধে রাখা, পানিশূন্য রাখা, খাদ্য বঞ্চনা—এসব নির্যাতন নিয়মিতভাবে চালানো হয়। ভয় আর চাপে পড়ে পরিবারগুলো এক পর্যায়ে আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজন, গ্রামের বাড়ি, এমনকি এনজিও বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা পাঠাতে বাধ্য হয়। টাকা পেলেই অপহৃতকে অমানবিক পরিস্থিতিতে একপর্যায়ে রাস্তায় ফেলে যায়। কিছু ক্ষেত্রে, টাকাও নেওয়া হয় এবং তারপরও অপহৃতকে হত্যা করা হয় বা নিখোঁজ করে ফেলা হয়—যার সন্ধান আর পাওয়া যায় না।
এই অপহরণ চক্রের ভয়াবহ দিক হলো—এটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দু’ধরনের অপরাধী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত। সৌদি আরবের বহু স্থানে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অপরাধী চক্র রয়েছে যারা প্রবাসীদের দুর্বলতাকে পুঁজি হিসেবে দেখছে। আবার এদের সঙ্গে প্রভাবশালী কিছু আরব নাগরিকের যোগসাজশও আছে বলে বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। কারণ তারা গাড়ি, নিরাপদ আস্তানা, অস্ত্রশস্ত্র এবং পুলিশ পরিচয়ের মতো সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করে তোলে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের কিছু দালালচক্রও এই আন্তর্জাতিক অপরাধকাজের সঙ্গে জড়িত। তারা দেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর সময় অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার পাশাপাশি সৌদিতে নতুন আগতদের ঠিক কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে তথ্য ফাঁস করে দেয়। ফলে যে যুবক বা পুরুষটি নতুন স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরবে পা রাখল, হয়তো এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে অপহরণের শিকার হয়ে যেতে পারে।
যারা সৌদি আরবে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থান করছে, তাদের ভয় আরও বেশি। তারা পুলিশের কাছে যেতে পারে না, অভিযোগ করতে পারে না, এমনকি হাসপাতালেও যেতে ভয় পায়। এই ভীতি অপহরণকারীদের শক্তিশালী অস্ত্র। কারণ ভুক্তভোগীরা জানে যে অভিযোগ করলে নিজেকেই গ্রেফতার বা ডিপোর্টেশনের ঝুঁকিতে পড়তে হবে। তাই তারা নীরবে সব সহ্য করে, আর চক্রের এই সুযোগটিই মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে।
বাস্তবতা হলো—অপহরণের পর পরিবারের উপর মানসিক চাপ ভয়াবহ। দরিদ্র পরিবারগুলো হঠাৎ করে কয়েক লাখ টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। তাদের জমিজমা বিক্রি হয়, ধারদেনা বাড়ে, কখনও বাড়িতে থাকা নারীরা ভিতরে ভিতরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। দিনে দিনে এই পরিবারগুলি অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয় যা সমাজে নতুন সমস্যার জন্ম দেয়।
অন্যদিকে, অপহরণ থেকে মুক্ত হয়ে প্রবাসীরা যে মানসিক আঘাত নিয়ে ফিরে আসে—তা বহন করে বছর পর বছর। তারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। অনেকেই কাজ হারায়, ভয়ের কারণে বাইরে বের হতে পারে না, এবং ট্রমার কারণে বারবার দুঃস্বপ্ন দেখে। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকের কাছে মানসিক চিকিৎসা, কাউন্সেলিং বা সামাজিক সহায়তা—এসব বিলাসিতা মাত্র।
সৌদি আরবে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ভয়াবহ এই পরিস্থিতি নতুন নয়। বহু বছর ধরে এটি চলছে, কিন্তু অধিকাংশ ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না। কারণ অপহৃত ব্যক্তি দেশে জানাতে না চাওয়া, কিংবা ভয়, কিংবা সমাজের লজ্জা—এসব কারণে অভিযোগ হয় না। এছাড়া সৌদি আরবের আইনি কাঠামো কঠোর হওয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসও অনেক ঘটনার গভীরে যেতে পারে না, কিংবা যথেষ্ট মানবসম্পদ ও সক্ষমতার অভাবে অনেক সময় অল্প কিছু কেসের অনুসন্ধানে সীমাবদ্ধ থাকে।
যদিও কিছু ক্ষেত্রে সৌদি পুলিশ সফলভাবে অপহরণকারীদের আটক করেছে, কিন্তু তা অপরাধের তুলনায় খুবই সামান্য। বড় নেটওয়ার্কগুলো থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ এই চক্রগুলো মোবাইল সিম বারবার পরিবর্তন করে, অবস্থান ঘন ঘন বদলায়, নতুন সহযোগীদের ব্যবহার করে, এবং নিজেদের এমনভাবে ঢেকে রাখে যা ধরার প্রায় অসম্ভব।
একদিকে সরকার রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য নতুন শ্রমবাজার খুঁজছে, অন্যদিকে বিদেশে থাকা শ্রমিকরা ক্রমেই ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কতটা নিশ্চিত হচ্ছে—তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের জন্য অমূল্য সম্পদ, কিন্তু বিদেশে তাদের জীবন কতটা নিরাপদ—এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজও অস্পষ্ট।
সৌদি আরবে বাংলাদেশি প্রবাসীদের অপহরণ চক্র নির্মূল করতে হলে প্রথমত স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন। দূতাবাসকে আরও সক্রিয় ও দক্ষ হতে হবে। হটলাইন, আশ্রয়কেন্দ্র, জরুরি উদ্ধার টিম—এগুলো আরও শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে দেশে বিদ্যমান দালালচক্রকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে; তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, আইনি শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এছাড়াও নতুন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ব্যতীত সৌদিতে পাঠানো উচিত নয়। ভাষা, আইন, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা, কোথায় গেলে নিরাপদ, কার সাহায্য পাওয়া যায়—এসব বিষয়ে আগামী প্রবাসীদের সচেতন করা জরুরি। কারণ অজ্ঞতা ও ভয়—এটাই অপহরণকারীদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
এই সমস্যার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো। মানুষ যখন সত্য জানা শুরু করবে, প্রতারণা ও অপহরণের কৌশল সম্পর্কে সচেতন হবে, তখন প্রবাসীরাও সতর্ক থাকবে। আর অপহরণকারীরা তাদের ফাঁদ পাততে গেলে বাধা তৈরি হবে।
সর্বোপরি, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে—একজন প্রবাসীর জীবন শুধু একটি মানুষের জীবন নয়; তার সাথে জড়িয়ে থাকে পুরো একটি পরিবার, সমাজ, দেশের অর্থনীতি। তাই বিদেশে যারা দেশের সুনাম ও স্বার্থ রক্ষায় শ্রম দিচ্ছে, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।
সৌদি আরবে প্রবাসীদের অপহরণ চক্র কেবল একটি অপরাধ নয়; এটি বাংলাদেশের শ্রমবাজার-নির্ভর অর্থনীতি ও প্রবাসী সমাজের উপর এক দীর্ঘস্থায়ী হুমকি। এই অন্ধকার বাস্তবতা ভাঙতে হলে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার—সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে আরও কত জীবন, কত পরিবার এই অমানবিকতার শিকার হয়ে নিঃশেষ হবে—তার সঠিক গাণিতিক হিসাব কোনোদিনও সম্ভব হবে না।
আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিষ্ট, columnistazad@gmail.com