শিরোনাম
◈ মার্কিন পাল্টা শুল্ক: সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের বহুমুখী তৎপরতা ◈ ১ ঘণ্টার ব্যবধানে মোহাম্মদপুরে দুই খু.ন ◈ কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা বা তার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া মানুষের মন থেকে তার উপস্থিতি মুছে ফেলে না: মাসুদ কামাল (ভিডিও) ◈ গোপালগঞ্জে আগামীকালের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত ◈ গোপালগঞ্জে হামলার প্রতিবাদে এনসিপির সারা দেশে সমাবেশের ঘোষণা, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি ◈ মে‌হেদীর ঘুর্ণীর পর তান‌জিদ ঝ‌ড়ে শ্রীলঙ্কার বিরু‌দ্ধে টি-‌টো‌য়ে‌ন্টি সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ ◈ রাজধানীর আদাবরে ডিশ ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা ◈ এবার চার উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকালেন এনসিপির নেতা-কর্মীরা ◈ জীবন-মৃত্যুর মতো পরিস্থিতি না হলে ঘর থেকে বের হবেন না: আসিফ মাহমুদ ◈ কুমিল্লায় নিজ ঘর থেকে নারী‌র রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার

প্রকাশিত : ১৬ জুলাই, ২০২৫, ১০:৫৭ রাত
আপডেট : ১৭ জুলাই, ২০২৫, ০২:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সময়ের কড়চা

৩৬ জুলাইয়ের চেতনা ধরে রাখতে হলে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই

শাহাজাদা এমরান: জুলাই শহীদ দিবস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৬ জুলাই আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার দিনকে জুলাই শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ দিনকে সরকার রাষ্ট্রীয় শোক হিসেবে ঘোষণা করেছে। যা ‘খ’ শ্রেণির আওতাভুক্ত।

আমরা জানি, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে পেটোয়া ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশ বাহিনী।

দেখতে দেখতে এক বছর পূর্ণ হলো। ১৬ জুলাই সারাবিশ্ব দেখেছিল কী নির্মমভাবে আবু সাঈদকে হত্যা করেছিল। তার মৃত্যুতে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল গোটা দেশ। সারাবিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল প্রবাসীরা উত্তাল হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল যেন, ২০ কোটি মানুষের ঘরে ঘরে আবু সাঈদ বাস করছিল। সেদিন আবু সাঈদ হয়ে উঠেছিল জুলাই আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। তাঁর উঁচিয়ে দেওয়া হাত হয়ে যায় গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির দিশা।

এদিকে, একই দিন আন্দোলনে চট্টগ্রামে শহীদ হয়েছিল ছাত্রদল নেতা ওয়াশিম। সারাদেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফেসবুকে স্ট্যাটাসে আবু সাঈদকে জুলাই আন্দোলনের বীর শ্রেষ্ঠ ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, ১৬ জুলাই ছাত্রদের আন্দোলনকে নস্যাৎ, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা হিসেবে পুলিশ বাহিনী তাদের উপর বর্বর আক্রমণের নীল নকশা রূপায়ণ করে এবং নির্যাতন চালায়।

আবু সাঈদ ছিলেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক। পুলিশ লাঠিচার্জ করে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় তাদের আন্দোলন। ঠিক এ সময় গর্জে উঠেছিল আবু সাঈদ। তিনি তার দুই হাত উঁচু করে পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে বলেছিলেন, হায়েনা গুলি কর। মাত্র ১৫ মিটার দূর থেকে দুজন পুলিশ তাঁর বুকে নির্দয়ভাবে গুলি চালায়। প্রথম গুলি করার পর নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল সে। আরেকটি গুলি করার পর সে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। সেদিন আবু সাঈদের এ জীবনদান ছিল জুলাই আন্দোলনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। সেদিন যদি আবু সাঈদ দুই হাত উঁচু করে প্রাণ না দিত, বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে না দিত, তাহলে এত দ্রুত ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুক্ত দেশ হতো কিনা, আওয়ামী লীগের পতন এত দ্রুত ত্বরান্বিত হতো কিনা সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে।

আজ দেখতে দেখতে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাত বরণের এক বছর পূর্ণ হলো। আবু সাঈদ যে জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে অবহিত হয়ে থাকবে আজীবন। এখন পর্যন্ত এভাবে আন্দোলনরত অবস্থায় কোনো শিক্ষার্থী তাঁর তাজা রক্ত বন্দুকের সামনে বিলিয়ে দিয়েছে কিনা আমার জানা নাই। আবু সাঈদের এই আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বহ্নিশিখা হয়ে জ্বলন্ত থাকবে।

আবু সাঈদ কেন সেদিন এমন আত্মত্যাগ করেছিল? কেন সে রক্ত দিয়েছিল, মূল্যবান জীবন দিয়েছিল? গত এক বছর ধরে আমরা কি তার হিসেব কষে দেখেছি? শুধুমাত্র একটাই কারণ, বৈষম্যমুক্ত, সমৃদ্ধশালী একটি স্বপ্নীল বাংলাদেশ নির্মাণ করব বলে। যেই বাংলাদেশে ভোটের জন্য রাজপথে আর রক্ত দিতে হবে না, কথা বলার জন্য, নিরাপদে চলার জন্য জীবন দিতে হবে না, যেখানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থাকবে না। দিনের ভোট কেউ রাতে দেবে না। এমন একটি গর্বিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সেদিন আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মীর মুগ্ধরা তাদের তাজা প্রাণ দিয়েছিল।

কিন্তু ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে আজকের ২০২৫ সালের ১৬ জুলাই এক বছরে আমরা কি পেরেছি আবু সাঈদসহ অন্য হাজারো শহীদদের রক্তের প্রতিদান দিতে? না, পারি নাই। কেন পারিনি সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জানাতে চাই, ক্রমান্বয়ে ব্যাহত হতে চলেছে আবু সাঈদসহ শহীদদের আত্মত্যাগের মূল উদ্দেশ্য। এর দায় এড়াতে পারবে না বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ ২৪-এর আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য দলগুলোও।

আস্তে আস্তে আবু সাঈদের রক্ত থেকে আমরা অনেক দূরে চলে আসছি। গত এক সপ্তাহ ধরে আওয়ামী লীগমুক্ত নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদের চিন্তার চেতনার দৌরাত্ম্য, তাদের কথা বলার রঙ এবং ঢং, তাদের আচার আচরণ ও স্লোগান গোটা জাতিকে আবার ২৪-এর পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আমাদের দামাল ছেলেরা কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেও একটা সময় কিন্তু বিএনপি, জামায়াতসহ অপরাপর সকল রাজনৈতিক দলগুলো একতাবদ্ধ হয়ে ছাত্রদেরকে সামনে দিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। শুধু সম্পৃক্ত হননি, তাদের অসংখ্য নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে।

আজ আমরা দেখছি, ৫ আগস্টের আন্দোলনে যে রাজনৈতিক দলগুলো একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করেছিল, আন্দোলনে পাশে থেকেছিল, তাদের মধ্যেই আজ বিভাজন দেখা দিয়েছে, অতীব বিভাজন। একজন আরেকজনকে আক্রমণাত্মক কথা বলছে, স্লোগান দিচ্ছে। একজন বলছে বাংলা ছাড়, আরেকজন বলছে বাংলা কি তোর বাপ-দাদার।

এসব বিভাজন রাজনীতি ফিরে পাওয়ার জন্য ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট এসেছিল? প্রায় ১ হাজারের অধিক শহীদ জীবন দিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ আহত কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কি তাদের হীন রাজনীতির চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য?

একটি সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনতিবিলম্বে হওয়া ছাড়া এই বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার আর কোনো বিকল্প দেখছি না। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর দেখছি না।
আমি এই কলামের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা এই দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। দেশ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গত ১৫-১৬ বছরে আপনারা আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন, শত শত নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে, জেল খেটেছে, আহত হয়েছে, গুম হয়েছে, নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে। এসব কি আপনারা ভুলে গেছেন?

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে কিন্তু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরাজিত শক্তিগুলো কিন্তু বসে নেই। তারা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। আপনাদের বিভাজন তাদেরকে উল্লসিত করছে, উদ্ভাসিত করছে। আপনারা বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি যত বিভাজিত হবেন, পরাজিত শক্তিগুলো ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। দূরে সরে যাবে ৫ আগস্টের চেতনা।

সর্বশেষ আমি জামায়াতসহ অপরাপর ইসলামী দল ও এনসিপিকে বলব, প্লিজ আপনারা আর যাই হোক, জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মতো একটি সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের মানুষ যাকে মাদার অব ডেমোক্রেসি বলে আখ্যায়িত করেছে সেই বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে দয়া করে কটুক্তি করবেন না। দল হিসেবে বিএনপি দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। তাদের অবশ্যই সমালোচনা করবেন, রাজনৈতিক বক্তব্য দেবেন কিন্তু মাইনাস বিএনপি যদি চিন্তা করেন তাহলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে যেতে পারে। কারণ, পরাজিত শকুনের লোলুপ দৃষ্টি আকাশে বাতাসে ঘুরছে।

একই সাথে বিএনপিকেও বলব, যেহেতু জামায়াত আপনাদের দীর্ঘ দিনের মিত্র তাই তাদেরকে এমন কিছু বলবেন না, যাতে মানুষ আবার আপনাদের খোঁটা দিতে সুযোগ না পায় এবং জামায়াতও চেইত্তা না যায়। আজকে দেশের যখন সবচেয়ে ক্রান্তিকাল, দুর্যোগময় সময়, তখন দেশের বিএনপি ও জামায়াতের দৃঢ় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু এ সময়ে কেন এত যোজন যোজন দূরত্ব?

একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন। মিছিল দিয়ে মাঠ কাপাচ্ছেন। নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আমি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ করব, দয়া করে আপনারা আবু সাঈদদের রক্তের সাথে বেইমানি করবেন না। প্রতিজ্ঞা করুন, আপনাদের জন্য যেন তাদের রক্ত বৃথা না যায়। আপনারা হানাহানি করবেন না, বিভাজন করবেন না, যত দ্রুত সম্ভব একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।
আপনারা যেভাবে একে অপরকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তা যে শুধু আপনারা করছেন তা নয়। এর পেছনে রয়েছে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন। এটা যত দ্রুত বুঝবেন ততই মঙ্গল বয়ে আনবে আপনাদেরসহ দেশ এবং জাতির।

আরেকটি কথা বলে লেখাটির ইতি টানতে চাই। বিএনপি যদি কোনো কারণে ডাউনে চলে যায়, তখন দেখা যাবে এক সময় জামায়াত ও এনসিপিও ডাউনে চলে যাবে। তখন আবার পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগ জেগে উঠবে। সুতরাং আমরা আর রক্ত দিতে চাই না। আমরা আর সংগ্রাম চাই না, কোনো মায়ের বুক খালি করতে চাই না। আমরা চাই অনতিবিলম্বে সব দলের ঐক্যমতের মাধ্যমে একটি জাতীয় নির্বাচন হোক। এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এসে জাতিকে একটি সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দিক। এর জন্য বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ঐক্যের কোনো বিকল্প নাই।
আসুন আমরা একটি সুন্দর দেশ পুনর্গঠনে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

লেখক: সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক। ০১৭১১-৩৮৮৩০৮।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়