আহসান হাবিব: [১] নারীকে কেন বুঝতে হবে পুরুষকেইÑএটা আমার মাথায় ঢুকে না। না, আমি নিজে পুরুষ বলে বলছি না, বলছি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে। আমি যখন কারো সাথে সম্পর্কিত হই, তখন সম্পর্কই আমাকে চালিত করে। আলাদা করে কেন আমাকে কি ব্যবহার করতে হবে তা প্রয়োগ করতে হবে? আচরণ কিংবা ব্যবহার কি আলাদাভাবে অস্তিত্বশীল কিছু যেমন ধর্মবাদীদের কাছে আত্মা? দেহ নাকি তখনই সচল হয়ে ওঠে যখন এই আত্মা নামক বস্তুটি দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। [২] নারী এবং পুরুষের সম্পর্কে থাকে বিবিধ রূপ। প্রতিটি সম্পর্ক ভিন্ন ভিন্ন আচরণ দাবী করে। কেন? কারণ সম্পর্কই এটা নির্ধারণ করে দেয়। কন্যার সংগে একরকম, কন্যার মায়ের সংগে অন্যরকম। এটা গড়ে উঠেছে লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ধারায়। প্রতিটি ধারায় সাধারণ যে বৈশিষ্ট্য তা হলো টিকে থাকার পক্ষে সহায়ক কি না। এটি দুএক বছরের বিষয় নয়। লক্ষ লক্ষ বছরের বিষয়।
একটা সময় যখন এই হোমো স্যাপিয়েন্স প্রকৃতিকে জানতে শুরু করলো এবং বিকল্প প্রকৃতি গড়ে তুলতে সমর্থ হয়ে উঠলো, তখন এই বিকল্প প্রকৃতির নিয়ম কানুন একদিকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এবং নিজেদের আন্তঃলড়াইয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে সেগুলিই গৃহীত হতে লাগলো যা অস্তিত্বের পক্ষে সহায়ক। প্রকৃতির যেমন নিজস্ব নিয়ম আছে, মনুষ্যসৃষ্ট প্রকৃতি মানে সমাজেরও নিয়ম আছে। এই নিয়মকানুন কিন্তু কিন্তু একক মানুষের সৃষ্ট নয়, এটা ঘটে চলে স্বতঃস্ফূর্ত এবং ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে। কিন্তু যখন তা পরিবর্তনের প্রয়োজন আবশ্যক হয়ে ওঠে তার নিয়মেই, তখন মানুষের সচেতনতার দরকার পড়ে। এই আলোকে যদি আমরা নারী পুরুষের সম্পর্ক বিচার করতে বসি, তাহলে দেখবো এখানে মূল বৈশিষ্ট্য-টিকে থাকা-তা সবসময় প্রধান বিবেচ্য হয়ে থেকেছে। একদিকে নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যা তার নিজের টিকে থাকার স্বার্থে চালিত আবার মনুষ্য নির্মিত প্রকৃতির নির্মিত বৈশিষ্ট্য যা তার টিকে থাকার স্বার্থে চালিত-এই উভয় বৈশিষ্ট্য অবচেতনভাবেই বিবেচ্য থাকে।
এখন এই বৈশিষ্ট্যকে সামনে নিয়ে সমাজিবিকাশের ধারায় নারী হয়ে বংশবিস্তারের বাহন। পুরুষ ছাড়া এই বিস্তার সম্ভব নয়, কিন্তু সমাজের নিয়মে তা পুরুষের অনুকূলে চলে এসেছে। কিভাবে? মানুষ যে বিবাহপ্রথা গড়ে তুলেছে তার কারণ উত্তরাধিকারের কাছে আহরিত সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর। এই মালিকানা সে দিতে চায় কার হাতে? প্রধানত ছেলে সন্তানের হাতে। কেন? কারণ মেয়েসন্তান পিতার সংসার থেকে অন্য পুরুষের সংগে ঘর বাঁধে এবং বংশবিস্তার ও সম্পদের মালিকানা হস্তান্তরের কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। কথাটা শুনতে খারাপ হলেও এটা নির্মম বাস্তব সত্য যা সমাজব্যবস্থার নিয়মের মধ্যেই আছে। সেই নিয়ম ত্রুটিপূর্ণ কি না তা নিশ্চয় আলোচনার দাবী রাখে। এই যে নারী তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই পুরুষের কিংবা একটি ব্যবস্থার বলি হয়ে পড়লো যেখানে লাভবান হলো পুরুষ, সেখানে পুরুষ দায়ী নয়, দায়ী ব্যবস্থা। উভয়ে ব্যবস্থার শিকার। এখন এই ব্যবস্থাই নারী এবং পুরুষের আচরণ ঠিক করে দিচ্ছে এবং তারা সেই আচরণ ব্যবহার করছে। এই আচরণ পরিষ্কারভাবেই পুরুষকে করে তোলে আধিপত্যবাদী, ফলে নারী মানুষ হিসেবে অত্যাচারিত হয় এবং প্রশ্ন ওঠে এটা বদলানোর। এই বদলানোতে একক পুরুষের কোন ভূমিকা নাই। আর এই ভূমিকা ব্যক্তিগত নয়, রাজনৈতিক এবং এই রাজনীতি কোনমতেই বুর্জোয়া রাজনীতি নয়, রাজনীতি সমাজবদলের।
[৩] নারী কিংবা পুরুষের এই যে আচরণ যা উদ্ভুত হচ্ছে ব্যবস্থা কর্তৃক, সেখানে নারীকে বোঝার বিষয়টি কি করে ব্যক্তি পুরুষের উপর বর্তায়? পুরুষ নারীকে বুঝে না- পুরুষের বিরুদ্ধে এই হচ্ছে নারীর একটি প্রধান অভিযোগ। আসলে নারী পুরুষকে বোঝে? উভয় উভয়কে বোঝে না এই অভিযোগ সত্য। কারণ নারী যা চায় তা পুরুষের কাছ থেকে পায় না আবার নারীর কাছে থেকে পুরুষ যা চায় তা পায় না। এই না পাওয়ার কারণ একদিকে মানুষের জৈবপ্রকৃতি এবং সামাজিক ব্যবস্থাজাত। মানুষের স্বাভাবিক যৌনতাকে বেঁধ ফেলা হয়েছে স্বার্থের জোয়ালে। ধর্ম এবং যে কোন সমাজব্যবস্থা যৌনতাকে কাজে লাগিয়েছে ব্যক্তিগত সম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখার স্বার্থে। পুঁজিবাদ করেছে পণ্য। ফলত যৌনতাকে কিনে নিতে বাধ্য হয়েছে কারণ প্রাণী হিসেবে সে বহুগামি। যে ক্ষমতা বহুগামিতাকে কুক্ষিগত করেছে একগামীতার বিবর্ণ কোটরে, সেই ক্ষমতাই আবার কিনে নিচ্ছে তারই তৈরি যৌন ইন্ডাস্ট্রি থেকে কিংবা অন্য উৎস থেকে। ফলে সবখানে নারী হচ্ছে বহুগামিতার শিকার। নারীও এই কাজ করে কিন্তু তা খুব একটা আলোচনায় আসে না। আসলে এই ক্রয় বিক্রয় পুঁজির হাতে বন্দী, মানুষ তার ক্রীড়নক।
[৪] কোন নারীবাদী আন্দোলন বা চেষ্টা কিংবা ব্যক্তি পুরুষের বদলানো আচরণ দিকে এক অপরকে বোঝা যাবে না। তবে নারী যে সমাজসৃষ্ট না বোঝা কিংবা ডমিনেশনের শিকার, তা থেকে মুক্তির সেরা উপায় ব্যবস্থার রূপান্তর যেখানে ব্যবস্থাই সেই আচরণের জন্ম দেবে যা পারষ্পরিক সহযোগিতামূলক, আলাদা করে একে ষপরেকে বোঝার প্রয়োজন পড়বে না। লেখক: কথাসাহিত্যিক