শিরোনাম
◈ তেল আমদানি এখনো পুরনো দামে, যুদ্ধ দীর্ঘ হলে পরিস্থিতি পুনর্বিবেচনা হবে: সালেহউদ্দিন আহমেদ ◈ ট্রাম্পের আকস্মিক জি-সেভেন সম্মেলন ত্যাগ: ইরান-ইসরায়েল নয়, আরও বড় কিছু ঘটছে? ◈ জুলাই মাসের মধ্যে `জাতীয় সনদ' তৈরি করতে পারবো: আলী রীয়াজ ◈ ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ বয়কট করল জামায়াতে ইসলামী ◈ নেতানিয়াহুর ঔদ্ধত্যে ইসরায়েলের সামরিক অহংকার চূর্ণ, ইতিহাসে ফিরছেন আহমদ চালাবির ছায়া:হামিদ মীর ◈ ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জি-৭ নেতাদের বিবৃতি: ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান, ইরানকে ‘সন্ত্রাসের উৎস’ আখ্যা ◈ ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানাল ২১ মুসলিম দেশ ◈ ভয়াবহ যুদ্ধের ই‌ঙ্গিত দি‌য়ে  ইরা‌নের রাজধানী তেহরানের বাসিন্দাদের শহর ছাড়তে বললেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ◈ ইসরায়েল ইরানে পরমাণু বোমা ফেললেই, পাকিস্তান পরমাণু হামলা চালাবে নেতানিয়াহুর দেশে, এবার কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? ◈ দেখা হলে সাকিবকে  জিজ্ঞাসা করবো কেন আমার বিরু‌দ্ধে ভুল তথ্য দি‌য়ে‌ছি‌লেন : তা‌মিম ইকবাল

প্রকাশিত : ২৫ জুন, ২০২৪, ০১:৪৬ রাত
আপডেট : ২৫ জুন, ২০২৪, ০১:৪৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রবীন্দ্রসংগীত কেন পুরনো হয় না

আহসান হাবিব

আহসান হাবিব: [১] কয়েকদিন থেকেই একটি প্রশ্ন মাথায় ঠোকর মেরে চলেছেÑরবীন্দ্রনাথের গান কেন পুরনো হয় না? কি আছে এই গানের ভেতর? প্রশ্নটি হয়তো নতুন নয়। সেই শৈশব থেকেই এই গান শুনে আসছি, যত দিন যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এর নতুনত্ব বাড়ছে। তখন বেতারে শুনতাম এই গান। সুর কানে আসলেই বুঝে ফেলতাম কার গান বাজছে। তখন যে এই গান বুঝতাম তা নয়, এখনো সবটা বুঝি তাও নয়, তবে চিনে ফেলাতাম। কিভাবে চিনতাম? সুর শুনে। এই গানের সুর ছিল একদম আলাদা, আর সব গানের মত নয়। ছায়াছবি, আধুনিক, কীর্তন, লোক কিংবা রাগ সংগীতের সুর থেকে একদম আলাদা ছিল এর সুরের ধরণ। এর সুর বয়ে যেতো ধীরে, যেন কোন তাড়া নেই, টানা, অচঞ্চল গতিতে এগিয়ে যেতো। যখন দূর থেকে কানে আসতো এই গান, মনে হত অপরাহ্ণের রোদ লম্বা ছায়া ফেলে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে চলেছে। সন্ধ্যা কথাটি আমাকে এখনো ভাবায়। সন্ধ্যা মানে কি? ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসা একটা মোলায়েম তাপের আলোর সমাবেশ। সে আলোয় চারপাশের বস্তুরাজি অচেনা হয়ে আসছে। একটা গাঢ় ছায়া ফেলতে শুরু করে দিয়েছে, গোধূলিতে অস্তগামী সূর্য যেমন সময়কে মায়াময়, নীরব করে তোলে, রবীন্দ্রসংগীত যেন তেমনি একটি ছায়াছন্ন রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সন্ধ্যার আরও একটি গভীর অর্থ আছে-সন্ধ্যা মানে মিলন, সন্ধি। এই গান যেন আমাদের চেনা এবং অচেনা জগতের মিলনস্থল, চেনা জগতের বাইরে অচেনা জগতের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সে মুখ লুকায় অন্য কোন অন্ধকারে।
[২] বয়স যখন তিরিশের কোঠায়, তখন সংগীতের ছাত্র হলাম। গুরুর কাছে ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা, কিন্তু নিজে নিজে রবীন্দ্রসংগীত। কেন আমি বেছে নিলাম রবীন্দ্রসংগীত? একটিই কারণ-এর প্রতিটি গানের স্বরলিপি আছে। আমি স্বরলিপি দেখে গান কণ্ঠে তুলে নিতে শুরু করলাম। আমি দেখলাম আমার শ্রবণ শক্তির চেয়ে দৃষ্টিশক্তি বেশী। এটা সংগীতের জন্য একটি নেতিবাচক দিক, কিন্তু কিছুই করার নাই। যা আমি চোখে দেখি, তা কণ্ঠে তুলতে সুবিধা হয়, ফলে রবীন্দ্রসংগীত আমার ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠলো। এতে লাভ হল দুটি, সুর নিখুঁত ভাবে তোলা যায়, এর ভেতরে রাগ সংগীতের যে অসাধারণ প্রয়োগ তা বুঝা যায় আর একটি হল এর বাণীর ভেতরে প্রবেশ করা যায়। আমি ক্রমেই আবিষ্কার করলাম এই গানের প্রধান শুধু শক্তি সুর নয়, এর বাণী। এর বাণী এমনভাবে সুরের সংগে জড়িয়ে আছে যে আলাদা করা অসম্ভব। তবে সুরকে পাশে রেখে যখন বাণীর দিকে মনোযোগ দিচ্ছি, দেখছি আমি দাঁড়িয়ে পড়ছি সেই সন্ধ্যার কাছে। মানে একটা অদ্ভুত রহস্য আমাকে ঘিরে ফেলছে। আমি জাগতিক বাস্তবতার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে আমার অবচেতনে যেসব সত্য জমা হয়ে আছে, এই গান তারই শৈল্পিক প্রকাশ। বাণীর অর্থ ধরা যায়, যায় না, একটা মায়াজাল তৈরি করে ফেলে নিমেষেই। সেই বাণী যখন সুরে দেখছি, মনে হচ্ছে কোথাও কোন ফাঁক নেই, বাণীর মর্মভেদী ব্যঞ্জনা ফুটে আছে জ্যোৎস্নার মত। সেখান থেকে কোন বাদ গেলে কিংবা যুক্ত হলে যেন পুরো সৌধ ভেঙে পড়ে। একটাই গান, যতবার গাই, নতুন লাগে, যতবার শুনি নতুন লাগে। অন্য যে কোন গানের বেলায় আমি লক্ষ্য করছি এমন অনুভূতি জাগে না। অসংখ্য কালজয়ী গান শুনে দেখেছি, আনন্দ অসীম, এটা সাংগীতিক কিন্তু সংগীতের বাইরে এই গান যে অপার্থিব বোধে আক্রান্ত করে, তেমন করে না। যে কোন একটি রবীন্দ্রসংগীতের সামনে যখন দাঁড়াই, মনে হয় আমি যেন এক অমৃতলোকের যাত্রী। অশেষ এর অমৃত, পান শেষে ফুরায় না এর পানীয়।
[৩] বরাবরের মতই কয়েকদিন আগে একটি গান তুলতে গিয়ে সেই একই বোধে আক্রান্ত হলাম। ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’ কতবার শুনেছি এই গান, কিন্তু স্বরলিপি দেখে যখন কণ্ঠে তুলতে শুরু করলাম, এর সুর যতটা আনন্দ দিল, এর বাণী আমাকে নিয়ে গেল অধরা রহস্যের জগতে। ‘শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া, শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া, শুধু নব দুরাশায় আগে চলে যায়, পিছে ফেলে যায় মিছে আশা’ এই বাণী যখন পড়ছি, থমকে দাঁড়িয়েছি। কি এক আশ্চর্য জগত নির্মাণ, কি এক বেদনা এবং অপূরিত আকাংখার ভাষিক প্রকাশ। এই বহমান জীবনের পরতে পরতে কুটিলগ্রন্থির কি অসাধারণ উন্মোচন। আশাকে কিভাবে নতুন দুরাশা পিছে ফেলে এগিয়ে যায় জীবন। এই বাণী যেন আমাকে আমার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর এই বাণী যখন সুরে গেঁথে উঠলো, এক অনাস্বাদিত বোধ সমগ্র সত্তাকে আঁকড়ে ধরল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও এই বোধ থেকে মুক্তি মিলল না। যতবার গাই, ততবার একই বোধে আক্রান্ত হই, যতবার শুনি প্রিয় শিল্পীদের কণ্ঠে, বিশেষত দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে, চাপা ক্রন্দন কণ্ঠনালী ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। ‘অশেষ বাসনা লয়ে ভাঙা বল, প্রাণপণ কাজে পায় ভাঙা ফল’ ভাঙা তরী ধরে ভাসে পারাবারে, ভাব কেঁদে মরে ভাঙা ভাষা’ এই অংশটুকু যখন পাঠ করি, বিস্ময়ে অভিভুত হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় খোলা থাকে না। ‘ভাঙা ফল’ কি? আমি হাজার চেষ্টা করেও ওকে বস্তুময় করতে পারি না, শুধু নিজ ব্যর্থতার ছবি সামনে ঝুলে থাকে।
‘ভাঙা ভাষা’ এই শব্দ দুটির কাছে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থমকে থাকি। ভাষা আবার ভাঙা হয় কি করে? হয়, মন বলে ওঠে ‘হয়’, আমার ভেতর চঞ্চল হয়ে ওঠে, শান্তও হয়ে আসে নিবিড় নীরবতায়। ‘হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়, আধোখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়, লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো বিশ্বাসে, শুধু আধোখানি ভালোবাসা’ শেষ এই চরণে পৌঁছে বিস্ময়ের এক ঘোর আমাকে ঘিরে ধরে। ‘আধো পরিচয়’, ‘আধোকথা’, ‘আধো বিশ্বাস’, ‘আধো ভালোবাসার বিমূর্ততায় আমি নিপতিত হলাম, যেন কোন এক কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্ত আমাকে গ্রাস করে ফেললো এক লহমায়। এমন গান অজস্র, যার বাণীর কাছে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই দাঁড়িয়ে থাকা শেষ হয় না। ‘এসেছিলে তবু আসো নাই’ এর মত উপস্থিতিকে অদৃশ্য মনে হয়, না আসার গভীর দুঃখ জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। তখন আকুলতা জাগে, গেয়ে উঠি ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’। কি করে একজন দাঁড়ায় আঁখির আগে? এ এক আশ্চর্য নিবেদন, আশ্চর্য চিত্রাঙ্কন। এই বাক্য উচ্চারণের সংগে সংগে এক নিমেষে হৃদয়ের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। প্রিয় কোন না পাওয়া মুখশ্রী সামনে এসে দাঁড়ায়, হায় সে নাই, হারিয়ে গেছে। একটা অসীম হাহাকার সমগ্র সত্তাকে ঘিরে ধরে, মুক্তির কোন উপায় থাকে না। এক অজানা আমি, যার সন্ধানে হয়তো জীবন কেটে যাচ্ছে, পাওয়া হয়ে উঠছে না, তার ছবি রবীন্দ্রসংগীতের প্রতিটি পংতিতে পংতিতে। বোধের কিংবা আকাংখার যেমন মৃত্যু নাই, এই বাণীর তেমন যেন পুরনো হওয়া নাই। সতত নতুন হয়ে থেকে যায়, যতবার মুখোমুখি হই, লাগে ঝকঝকে, নতুন, চির পুরাতন, চির নতুন। লেখক: কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়