ড. কামরুল হাসান মামুন: আমার কন্যা বিয়াংকার ফিজিক্স সাবজেক্টের বাইরে লিবারেল আর্টসের একটি সাবজেক্টে একটি রিপোর্ট লিখতে হবে। এইটা ওর ফাইনাল পরীক্ষার অংশ। সেই রিপোর্টের শিরোনাম পড়ে আমি যে আনন্দ পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। বাংলায় তর্জমা করলে ওর রিপোর্টের শিরোনাম হলো, আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশে সাংস্কৃতিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এবং এই বিষয়ে ও এ-গ্রেড পেয়েছে। বিষয় সেটা না। বিষয় হলো এরকম একটি বিষয় নির্বাচন করা। বিষয় হলো, ও বাংলাদেশের একটি সমস্যাকে ওর একাডেমিক রিপোর্টের অংশ বানিয়ে ফেলেছে এবং নিজে নিজে এই বিষয়ে পড়াশোনা করে একটি রিপোর্ট লিখেছে। যে মেয়ের আবাসিক রুমের দেয়ালে বাংলাদেশের মানচিত্র, যে মেয়ে সামান্য যেইটুকু গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছে সেটির বিষয়ও বাংলাদেশ বিষয়ক, যেই মেয়ে সামান্য সুযোগ পেলে বিদেশে বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তুলে ধরে, যেই মেয়ের মাতৃভাষা ইতালিয়ান আর যেই মেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়েও আমার সাথে কোনোদিন বাংলা ব্যতীত ইংরেজিতে কথা বলে না সেই মেয়ে যদি বাংলাদেশে ফিরে আসে তার কি একটা চাকরি হবে?
সে যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দরখাস্ত করে, চাকরি হবে না। কারণ সে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্ডার গ্রাজুয়েট করেনি। তার সরকারি চাকরি হওয়ার সম্ভবনাও শূন্য। অথচ ও যখন স্কুলে পড়ে তখনও পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে জানতো, প্রায় অধিকাংশ দেশের রাজধানী কোনটা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কে জানতো এবং এখনো জানে। সে বিদেশে বসেও বাংলাদেশের চলমান ঘণ্টার প্রতি নজর রাখে। আর বিদেশের ঘটনাতো অবশ্যই। আমার কন্যা এখানে বিষয় না। সে কেবল একটি উদাহরণ। এরকম অসংখ্য ছেলেমেয়ে আছে যারা বিদেশে বিশ্বের সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এদের জন্য বাংলাদেশকে তৈরি করা হয়নি। এরা ফিরে আসলে এদের কোথায় ধপপড়সসড়ফধঃব করা হবে আমাদের সরকারগুলো কখনো এসব নিয়ে ভাবেনি। তাদের মাথায় কেবল রেমিটেন্স থাকে। অথচ এই ছেলেমেয়েগুলোর জন্য দেশের নিয়মকানুনগুলো তৈরি করলে, তারা দেশের সরকারি চাকরি পেলে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলে দেশ বদলে যেত।
আচ্ছা আমার কন্যা যদি ফিরে আসে সে কি বাংলাদেশের ভূমি অফিসে, পাসপোর্ট অফিসে, ট্যাক্স অফিসে গিয়ে নিজে নিজে কোন কাজ করে আসতে পারবে? আমার বাংলাদেশকে কি সেইভাবে প্রস্তুত করেছি? ওকে সাহায্যের জন্য আমিতো আজীবন থাকবো না। সেতো ছোটবেলা থেকেই ব্যর্থ হচ্ছিল। স্কুলে প্রথম ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল গ্রীন হেরাল্ড স্কুলে। সেখানে সে ফেইল করেছিল কারণ আমরা তাকে ভর্তির জন্য কোচিং করাইনি, প্রস্তুত করিনি। আমারই ভুল ছিল। এরও আগে ভেবেছিলাম ভিকারুন্নেসায় ভর্তি করাবো। তখন দেখলাম ভর্তি ফরম তুলতে ভোর তিনটায় গিয়ে স্কুলের সামনে লাইন দিতে হবে। এই স্কুল ছাড়া বাংলা মাধ্যমের আর কোনো ভালো স্কুল আমার মতে তখন ছিল না। তারপরেই গ্রীন হেরাল্ড স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াই। তারপর ভেবেছিলাম ইংরেজি মাধ্যমের Sunbeams school বা Sunnydale স্কুলে দেবো। কিন্তু পরে জানলাম জন্মের সাথে সাথেই সেখানে ভর্তির জন্য নাম লিখাতে হয়। এরপর ইংরেজি মাধ্যমের সবচেয়ে কম বেতনের কিন্তু ভালো মানের স্কুল ধানমন্ডি টিউটোরিয়াল স্কুলে ভর্তি করাই। আসলে আমি চেয়েছিলাম বাংলা মাধ্যমেই পড়ুক। কিন্তু সিস্টেম দেয়নি। আমি চেয়েছিলাম ইংরেজি মাধ্যমের নিজস্ব ক্যাম্পাস আছে এমন স্কুলে পড়ুক পড়াতে পারিনি। আমি যদি চাই কন্যা দেশে ফিরে আসুক সেকি পারবে বাংলাদেশের ডাইনামিক্স বুঝে চলতে? বাংলাদেশ কি প্রস্তুত সহজ, সরল, সৎ মানুষদের জায়গা করে দিতে? লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :