শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৩ মে, ২০২৪, ০১:৩৯ রাত
আপডেট : ২৩ মে, ২০২৪, ০১:৩৯ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু : ইরানের ব্যর্থতা কোথায়? 

রেজা ঘটক

রেজা ঘটক: ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে নিয়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রকে দুষছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। তিনি বলছেন যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অভ্যন্তরে উড়োজাহাজ চলাচল সংকটের মুখে পড়েছে। গত রোববার আজারবাইজানসংলগ্ন ইরান সীমান্তে একটি বাঁধ উদ্বোধন করে ফেরার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি। এটি ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারজাকান এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদোল্লাহিয়ান এবং আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ প্রাদেশিক কর্মকর্তাও ওই হেলিকপ্টারে ছিলেন। তাঁরা সবাই নিহত হয়েছেন।

এ দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে লাভরভ বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় তাদের তৈরি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ ইরানে সরবরাহের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রবাসী এটি অস্বীকার করে। কিন্তু সত্যিটা হলো, বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এর ফলে তারা উড়োজাহাজসহ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিভিন্ন যন্ত্র মেরামতে খুচরা যন্ত্রাংশ পায় না। রাইসি যে হেলিকপ্টারে ছিলেন, সেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেল ২১২ মডেলের। যুক্তরাষ্ট্র ও বড় বড় কয়েকটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের আরোপিত কয়েক দশকের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের পক্ষে তাদের উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ পাওয়া বা হালনাগাদ করা কঠিন হয়ে উঠে।

১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেল ২১২ হেলিকপ্টার বাজারজাত শুরু হয়। গত শতকের সত্তরের দশকে ইরান এই মডেলের বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার কেনে। সেই সময় ইরানের শাসনক্ষমতায় ছিলেন মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহের পতন ঘটার পরও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে ইরান। অনেকগুলো এখনো ইরানের বিমানবহরে আছে। কিন্তু ইরানে বিপ্লবের পর তেহরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব মেরামতে যন্ত্রাংশ কেনাটা ইরানের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালের হিসাবে ইরানের ২৩টি এয়ারলাইনসের বহরে ৩ শতাধিক উড়োজাহাজ ছিল। সেই সময় এর মধ্যে মাত্র ১৫৬টি উড়োজাহাজ চলাচল করছিল। অর্থাৎ অর্ধেক উড়োজাহাজ বসে ছিল। মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশ না থাকায় এসব উড়োজাহাজ বসিয়ে রাখা হয়েছে। মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ না পাওয়ার কারণে এসবের নিরাপত্তা নিয়েও দেখা দেয় উদ্বেগ।
ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানে অসংখ্য বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব বিমানের প্রায় সবই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। সাম্প্রতিক সময়ে বেল ২১২ হেলিকপ্টারের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালে কানাডা জানায়, তারা আর বেল ২১২ মডেলের হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে না। বেল ২১২ নিয়ে করা এক তদন্তে এই হেলিকপ্টার উড্ডয়নের সময়ে নানা যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি উঠে আসার পর এমন সিদ্ধান্ত নেয় কানাডা। বেল ২১২ হেলিকপ্টারটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি টেকসই ও চালানো সহজ। তাই বেসামরিক যোগাযোগেও এর ব্যবহার শুরু হয়। বেল ২১২ মডেলের হেলিকপ্টারের ক্রুসহ ১৫ যাত্রী বহনের সক্ষমতা রয়েছে। এটি সামরিক কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণের কাজেও ব্যবহার করা যায়। রাইসির হেলিকপ্টারটিকেও ১৫ যাত্রী বহনের উপযোগী করে রূপান্তর করা হয়।

বেল ২১২ হেলিকপ্টারটি একজন বা দুজন পাইলট ওড়াতে পারেন। এটি ১৭ দশমিক ৪১ মিটার দীর্ঘ ও উচ্চতায় ৩ দশমিক ৮৩ মিটার। খালি অবস্থায় এর ওজন ২ হাজার ৯৬২ কেজি। এটি সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৮০ কেজি নিয়ে উড়তে পারে। এতে ২টি পাখা ও ১ হাজার ৩০০ কিলোওয়াটের ইঞ্জিন থাকে। এর প্রতিটি পাখা ১৪ দশমিক ৬৩ মিটার লম্বা। হেলিকপ্টারটি সাধারণত ঘণ্টায় ১৯০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে এর গতি ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এটি একনাগাড়ে ৪৩৯ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। এ ছাড়া এটি ১৭ হাজার ৩৮৮ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম। ইরানের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি ৪৫ বছরের পুরোনো। ইরানের সামরিক বাহিনীতে এ ধরনের ১০টি হেলিকপ্টার রয়েছে। ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ জারিফ ইরানের প্রেসিডেন্ট ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের মৃত্যুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। 

তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটন উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে ইরানের জনগণ আকাশপথের সুবিধা উপভোগ করতে পারছেন না। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ইরানের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার সঙ্গে ওয়াশিংটনের কোনো ভূমিকা নেই। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইরান সরকারই এর জন্য দায়ী। তারা এ ধরনের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ৪৫ বছরের পুরোনো হেলিকপ্টার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে ইরানের পক্ষ থেকে এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুরোনো মার্কিন হেলিকপ্টার বাদ দিয়ে রাশিয়ার হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারত ইরান। এভিয়েশন শিল্পের পরামর্শদাতা রিচার্ড আবুলাফিয়া বলেছেন, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা কালোবাজার বা চোরাই বাজার থেকে যন্ত্রাংশ কিনছে। কিন্তু তাদের কাছে বিকল্প হিসেবে রাশিয়ার হেলিকপ্টার ব্যবহারের সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা সে পথে হাঁটেনি।

রিচার্ড আবুলাফিয়া বলেন, ইরান নিষেধাজ্ঞার দোহাই দিচ্ছেন, সেটি ঠিক আছে। কিন্তু রুশ হেলিকপ্টারের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। রাশিয়ার হেলিকপ্টার মানের দিক থেকে অনেক ভালো। বেল ২১২–এর মতো পুরোনো হেলিকপ্টারে করে প্রেসিডেন্টকে সফর করতে দেওয়া তাদের ঠিক হয়নি। নিজেদের অদক্ষতা ঢাকতে ইরানি কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞার দোহাই দিচ্ছে। তারা রাশিয়ার এমআই-১৭ যেকোনো সময় কিনতে পারত। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। পুরোনো হেলিকপ্টার ওড়ানোর জন্য যে রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন, তা ঠিকমতো করা হয় কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বেল ২১২ অনেক পুরোনো মডেল। এর অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কালোবাজারে পাওয়া যায়। অর্ধশতাব্দী পুরোনো হেলিকপ্টার, যদি নিখুঁতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাহলে তা ঠিক আছে। কিন্তু কালোবাজারের যন্ত্রাংশ এবং স্থানীয় রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি নিশ্চয়ই কোনো ভালো সমন্বয় নয়।

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে নিয়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ইরান যে ভুলটি করেছে সেটি হলো, তারা কেন এখনো পুরান মডেলের যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে। যেটি তাদের কাছে একটি শত্রু দেশ। অথচ কেন তারা মিত্র দেশ রাশিয়ার তৈরি উন্নত হেলিক্প্টার ব্যবহার করছে না। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা থেকে সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো ইরানের প্রসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। এটি ইরানের জন্য ভয়ংকর একটা অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি থেকে ইরান কতটুকু শিক্ষা নেবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিপরীতক্রমে রাইসিকে হত্যা করার জন্য যদি সিআইএ ও মোসাদ সত্যিই কোনো যৌথ প্রযোজনায় দূর নিয়ন্ত্রিত মিশাইল হামলা করেই থাকে, সেটিতে তারা শতভাগ সফল হয়েছে এবং ইরান কার্যত এই হামলা প্রতিরোধ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ইরানের কাছে মিত্র দেশ রাশিয়া থেকে আকাশ বহরের আরো শক্তিমত্তা তৈরি করা মোটেও কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এটি তারা এখনো করেনি বা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার বলি হলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসি ও তার শীর্ষ কর্মকর্তারা। ২২-৫-২৪। ফেসবুক থেকে 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়