আজিজুর রহমান আসাদ: নারীবিদ্ধেষী ব্যাটাগিরি বদমায়েশির বয়স খুব বেশি দিনের না। মানুষ কিংবা হোমোসেপিয়েন্স প্রাণিটি আসলে জন্ম থেকেই সবাই ‘নারীবাদী’। সাম্প্রতিক ফসিল রেকর্ড থেকে ধারণা করা হয়, মানুষের ইতিহাস প্রায় ৫০ লক্ষ বছরের। দীর্ঘ সময় ছিল আহরণ ও শিকার এর কালপর্ব, যৌথ গোত্রীয় সমাজে। কৃষির সূচনাও প্রায় ১ লক্ষ বছরের বেশি। পুরো সময়টা আদি-সাম্যবাদী সমাজ। একই সাথে মাতৃসুত্রীয়। ফলে, নারী-পুরুষ সম্পর্কও ছিল সাম্যের। ‘নারীবাদ’ মানে এই বোধ যে মানুষ হিসেবে যেকোনো নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদা, সুযোগ ও সম্মান পাওয়ার অধিকারী।
মাত্র হাজার দশেক বছর আগে উদ্ভব ঘটে ‘দাস’ সমাজের, দাস ও দাসমালিক শ্রেণি সমাজের। ইউরোপে লোহার শিকলে বাধা দাস, আর ভারতে ধর্মের নামে মগজে মতাদর্শের শিকলে বাধা দাস, যাদের আমরা অচ্ছুৎ বা দলিত বলি, ব্রাহ্মণ্যবাদের কল্যাণে। শ্রেণির উদ্ভবের সাথে ঘটে পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব। ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’, ঘটে একই সাথে। আমরা দেখি নারীর অধস্তনতা, সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চনা, পতিতাবৃত্তি, নারীকে বস্তাবন্দী করা, ধর্মগ্রন্থে পশুর সাথে তুলনা করা, ভোগ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করা (মালে গনিমত)। একই সাথে দেখি পুরুষ হয়ে উঠছে অত্যাচারী, ঘাতক ও ধর্ষক। শৈশব থেকেই ছেলে শিশুটিকে শেখানো হচ্ছে যে জ্ঞান বুদ্ধিতে সে তাঁর বোনের চেয়ে অনেকগুণ পিছিয়ে থাকলেও শুধু জন্মসূত্রে প্রাপ্ত উরুসন্ধিতে একটুকরো ঝুলন্ত মাংসপিণ্ডের জন্য সে ‘শ্রেষ্ঠ’। যাহার নাম, পুরুষ শ্রেষ্ঠত্ববাদ।
পিতৃতন্ত্র জন্মদিয়েছে ‘ব্যাটাদের’, যারা পুরুষ হিসেবে নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠ’ মনে করে। বিপরীতে এদের কাছে নারীরা হচ্ছে, হেয়, হীন, দুর্বল এবং ভোগ্যবস্তু। তুলনা করা হয়, ছেলা কলা, মিষ্টি, হরিণ ধরনের খাদ্যবস্ত, ধর্মীয় ওয়াজে। বিবেচনা করা হয় ‘মাল’ নামে। চূড়ান্ত বিচারে নারী ‘বস্তু’, মানুষ নয়। আর এসব বোধ, এই ব্যাটাদের মাথায় ঢোকানো হয় ধর্ম দিয়ে। পিতৃতন্ত্র টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে ধর্ম। আজকাল মাথায় সামান্য ঘিলু থাকলে আর গুগল করার মতো দক্ষতা থাকলে পিতৃতন্ত্র, নারীর প্রতি সহিংসতা, ম্যাস্কুলিনিটি ও নারীবাদ নিয়ে জানাবোঝা কোনো কঠিন কাজ না। আজকে আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি যে নারীবাদ একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, অন্তত যেকোনো সভ্য মানুষের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে, ইতর অসভ্য রাজাকারের বাচ্চাদের কারণে, এখানে নারীবাদ একটি সমস্যা। বাঙালি পোশাক পরা নারীকে নিয়ে ফেসবুকে নেতিবাচক প্রোপাগান্ডা হয়, নারীবাদী অভিধায়। প্রতিবাদে ‘#আমি নারীবাদী’ পোস্ট দিতে দেখি যারা নারীর প্রতি সহিংসতা ও নারীর আইনি সমঅধিকার নিয়ে কাজ করছেন, এমন সমাজকর্মীদের।
নারীবাদ নিয়ে কাদের কী সমস্যা? সমস্যাটা রাজনৈতিক। নারীবাদীদের নিন্দায় যে ফেসবুক পেজটি রয়েছে, সেটি আমি ঘুরে এসেছি (অসুস্থ শরীরে বেশিক্ষণ টিকতে পারিনি)। এখানে যা দেখলাম, তা আসলে রাজাকার আলবদরের রাজনীতির কর্মীদের একটি পেজ। অনেকেই ভাসুরের নাম মুখে নিতে চান না, কখনো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী কিংবা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ও বলতে চান না। এরা যে সেই জামাতে ইসলাম পছন্দ রাজাকার আলবদরের রাজনীতির প্রোপাগান্ডা সেলের একটি প্রকল্প এটি বোঝার জন্য, এদের ভাষারীতি, বিশেষ করা শাহবাগ বিরোধিতা, বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধিতা দেখলেই পরিষ্কার হওয়া যায়। কোদালকে কোদাল বলতে শিখুন, রাজাকার আলবদরের রাজনীতিকে আড়াল করে লাভ হবেনা।
আজকে শুধু নারীবাদী বলাটা আর যথেষ্ট না। যারা নারীকে তাঁর মৌলিক মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়, যারা নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে প্রতিটি ছেলে শিশুকে পটেনশিয়াল ধর্ষক বানাতে চায়, যারা নারীকে বস্তাবন্দী করে রাখতে চায়, এরা কারা? কোন রাজনীতির? কি উদ্দেশ্যে আজকে ফেসবুক খুলে নারীবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা করছে, সেই ব্যাখ্যা আমাদের দিতে হবে। আর শুধু পশ্চিমা লিবারেলদের প্রেসক্রিপশন অনুসারে নারীর অধিকার নিয়ে সুশীল আলোচনাও খুব কাজে দেবেনা। ফিরে যেতে হবে আমাদের বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতা, সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমামদের আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যে, নারীমুক্তির ধারায়। নারীবাদী আন্দোলনকে স্থাপিত করতে হবে সাম্যবাদী আন্দোলনের পাটাতনে। নারীমুক্তির আন্দোলনটি রাজনৈতিক, যা এগুতে পারে সাম্যবাদী মতাদর্শের অঙ্গীকারে। লেখক: গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :