শরিফুল হাসান: পদ-পদোন্নতি, ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা ধান্দায় কিংবা স্বার্থে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু বলা লোকের সংখ্যা যেভাবে হু হু করে বেড়েছে বাস্তবে অন্তরে ধারণ করে সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা করা লোকের সংখ্যা সেই তুলনায় যথেষ্ট কম। জানতে চান বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কী? আমি বলবো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে দেশপ্রেম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে সততা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে দুর্নীতি লুটপাটের বিরুদ্ধে অবস্থান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানলে তো বিদেশে টাকা পাচার করা যায় না। শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে বাঁচা যায় না। আফসোস ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বা চর্চার যথেষ্ট ঘাটতি মনে হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ আর ৭২ এর সংবিধানের বাংলাদেশ থেকে আমরা অনেক দূরে। অথচ বঙ্গবন্ধু এই জাতিকে শুধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাননি, আজীবন সংগ্রাম আর লড়াই করে সেই স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
এমন নেতা গোটা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, যিনি একটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, দিনের পর দিন লড়াই সংগ্রাম করে সত্যি সত্যি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কীভাবে এই দেশ চলবে বক্তব্য বিবৃতি সংবিধান করে পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ২৭ বছরের তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান যখন পূর্ব বাংলায় ফিরলেন তখন তিনি উল্লেখ করার মতো কোনো রাজনীতিবিদই নন। কিন্তু ১৯৭০ সালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে সবাইকে ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন এই বাংলার একমাত্র মহানেতা।
ইতিহাস বলে, ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে এই বাংলায় ফেরার সময় মুজিব শুধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য হিসেবেই পরিচিত। এই বাংলায় তখনও তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয়নি। উল্টোদিকে তখন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, খাজা নাজিমউদ্দিন, লিয়াকত আলী খান, নুরুল আমিন, এমনকি ফকা চোধুরীর মতো মুসলিম লীগ নেতারাও তখন এই দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুকে সেই তুলনায় তখনও বাংলার মানুষ চেনেনি। আরও দুই বছর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় বঙ্গবন্ধু তখন সেই দলের যুগ্ম সম্পাদক মানে ছয় নম্বর নেতা। প্রবীণ রাজনীতিবিদদের সাথে তুলনা করলে বঙ্গবন্ধু তখন সবেমাত্র এই বাংলার রাজনীতির মঞ্চে। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে এক দশকের মধ্যে তিনিই হয়ে উঠলেন এই বাংলার মূল নায়ক। মাত্র এক দশকে এভাবে মহানায়ক হয়ে ওঠার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয়দফা, ৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, এরপর বঙ্গবন্ধু নামে তিনিই এই বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা। এরপর তো ইতিহাস। ৭০ এর নির্বাচন, তাঁর নাম জপে কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া, স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাঙালির এই স্বাধীনতার জন্য আজীবন লড়াই করেছেন বঙ্গবন্ধু। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটেছে তাঁর জেলে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আপোস করেননি। বরং মাথা উচুঁ করে তীব্র প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন চোখে চোখ রেখে কথা বলতে। এমন সাহসী নেতা এই বাংলায় আর কবে ছিল। কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও কিংবদন্তি বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’ ফিলিস্তিন মুক্তি মোর্চার সাবেক নেতা, নোবেল বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, ‘আপোসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব ও কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বিশেষত্ব।’
অথচ কী নির্মম যে জাতিকে স্বাধীন করলেন স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় সেই দেশে কতোগুলো কুলাঙ্গার তাকে হত্যা করলো। এখানেই লুকিয়ে আছে বাঙালি জাতির চরিত্র। সারা জীবন যে মানুষটা অন্যের জন্য জীবন দেবে তার গীবত করতে আমাদের এক মুহূর্তও লাগে না। হুজুগে পড়ে আমরা ভুলে যাই কে আমাদের সত্যিকারের নায়ক আর কারা ভিলেন। আমি বিশ্বাস করি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যদি বঙ্গবন্ধুকে হায়েনারা হত্যা করতে না পারতো, আর মাত্র ১০টা বছর যদি বঙ্গবন্ধু এই রাষ্ট্র চালাতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশ হতো বিশ্বের উন্নত এক রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু হতেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। কিন্তু সেটি হয়ে উঠতে দেয়নি দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা।
আফসোস, টানা ১৬ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। দেশে গত ১৬ বছরে মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলা লোকের সংখ্যা হুহু করে বাড়লেও বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে আমাদের চেনার জন্য দরকার ছিল, জানার দরকার ছিল, তাঁর আদর্শের যেভাবে চর্চা করা দরকার ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে সেগুলো হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কী? আমি তো বলবো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে তার দেশ্রপ্রেম, তার অপোসহীনতা, তার সততা, সবসময় মানুষের কথা ভাবা, মানুষের জন্য অসীম ভালোবাসা। একটা মানুষ দেশকে কী পরিমাণ ভালোবাসলে বলতে পারেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’
আমাদের মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, কালোবাজারি, অর্থপাচার এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘১৯৭১-এ আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম প্রত্যেক ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। আজ ১৯৭৫-এ আমি আহ্বান জানাই প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।’ শুধু কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানেই তো দেশপ্রেম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে সৎভাবে বেঁচে থাকা। বঙ্গবন্ধু আদর্শ মানে সবার কথা ভাবা। ন্যায্য কথা বলা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানলে তো রাজনীতির নামে কেউ ভন্ডামি করতো না, রাজনীতি করে নিজের আখের গোছাতো না, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতো না।
বঙ্গবন্ধু তো এগুলোর কোনোটাই করেননি। অথচ আজ হরহামেশা সেগুলোই হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর কথা বলে দুর্নীতি লুটপাট বিদেশে টাকা পাচার সব হচ্ছে। যারা নানাভাবে দেশের সর্বনাশ করেন, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন তারা তো আসলে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম নেন। অথচ এদের বুকের মধ্যে বঙ্গবন্ধু নেই।
অবশ্য লোক দেখানো এই ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এদেশের একদল মানুষ বুকের মধ্যে সযত্নে বঙ্গবন্ধুকে লালন করেছে। আজীবন করবেন। আর সে কারণেই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে বলি সেই কথাটাই, ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি, যমুনা বহমান... ততোদিন রবে কীর্তি তোমার... শেখ মুজিবর রহমান’। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। লেখক: কলামিস্ট