কবীর সুমন: আমার একটি গানে আমি লিখেছিলাম, ‘আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ, আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।’ অনেকেই দ্বিতীয় লাইনটি উদ্ধৃত করেন নানান কারণে। প্রথম লাইনটি এড়িয়ে যান। আধুনিক সাহিত্য বিশ্লেষণ পদ্ধতির মূল কথা হলো টেক্সট। টেক্সটে যা আছে তার বাইরে কিছু বলা আধুনিক বিশ্লেষণপদ্ধতির বাইরে। আমার মূল টেক্সট ‘আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ,আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।’ কোথাও বলেছি কি আমি ধর্ম মানি না বা আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ শুধু তার স্বধর্মের (যদি তার ধর্ম থাকে) মানুষদেরই বুঝবে? আমি চাই যে যে ধর্মের শুধু সেই ধর্মের মানুষ নয়, যে-কোনও মানুষকেই বুঝবে। আমি মুসলমান। আমার ধর্মবোধ আমাকে শেখায় সব মানুষকেই আমার মতো মানুষ ভাবতে। ব্যস।
‘মুসলমান’ হলেই তবে সে মানুষ তা নয়। আমার ধর্ম মানুষকে মানুষ ভাবা, শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীকে নয়। এই কথাটা আমার টেক্সটেই রাখা আছে। সেটা যাদের মনে ধরছে না তাদের অন্য কোনও এজেন্ডা আছে, যার একটা হলো আমার দোষ ধরা। অনেকেই দেখেছি মনে করেন জনাবা সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করার জন্য আমি ইসলাম নিয়েছিলাম। সাবিনাকে যারা চেনার ও জানার সুযোগ পেয়েছেন তারা জানবেন তিনি সেরকম মানুষ নন। সেরকম শর্ত দেওয়ার মানুষই তিনি নন। এবারে ধরুন আমি তাকে বিয়ে করার জন্যেই ইসলাম গ্রহণ করেছি। তাতেইবা কী? কেউ ‘সহধর্মিনী’ হতে পারেন, ‘সহধর্মী’ হতে পারবেন না? আমি যতদূর জানি কিশোর কুমার একজনকে বিয়ে করার জন্য মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার এক বিখ্যাত উকিল বিয়ে করার জন্য (তাঁর পদবিও ছিল চট্টোপাধ্যায়) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পুরো নামটা দিচ্ছি না। কারণ তিনি সম্ভবত বেঁচে আছেন।
আমার ধর্মচিন্তা, ধর্মান্তর, দর্শন ইত্যাদি সম্বন্ধে জানতে চাইলে বাংলাদেশের ‘ছাপাখানার ভূত’ প্রকাশনি থেকে ছাপিয়ে বের করা সাজ্জাদ হুসাইনের ‘কবিরা’ বইটি পড়তে পারেন। যদি কারো মনে প্রশ্ন জাগে ইসলাম ধর্ম আমি পালন করে চলি কি? তাকে বলবো, বিষয়টা পরমেশ্বরের, কোনও মানুষের নয়। ইসলাম সম্পর্কে ধারণা থাকলে তিনি জানবেন পরমেশ্বরের সামনে, মালিকের সামনে একদিন আমার বিচার হবে। সেদিন তিনি যে রায় দেবেন সেটাই চূড়ান্ত। এ বিষয়ে নাক গলানোর অধিকার কোনও নশ্বর মানুষের নেই। অতএব নিত্যজীবনে আমি কতটা মুসলমান তা নিয়ে চর্চা করে আল্লাহ্ পাকের কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। খামোখা নিজের অশান্তি বাড়াবেন কেন? তিনি কিন্তু খুব সম্ভবত আপনাকে তাঁর উকিল হিসেবে নিয়োগ করেননি।
এবারে ‘আমি চাই হিন্দু নেতার...মানুষ শুধু’ এই দুটি লাইনসম্বলিত গানটি যখন গ্রামোফোন রেকর্ড করেছিলাম, প্রকাশ্যে গাইতে শুরু করেছিলাম তখন আমার নাম ছিল ‘সুমন চট্টোপাধ্যায়’। তখন কিন্তু কেউ আমায় বলেননি বা কোথাও লেখেননি, উনি নিজের নামে ব্রাহ্মণ্যধর্মের জাতের নিশান উড়িয়ে এই কথাগুলো গাইছেন। এটা ভন্ডামি। আগে তিনি ওই নিশানটা বাদ দিন, তারপর গাইবেন। একজনও এই কথাটা লেখেনি কোনও পত্রিকায়। ২০০০ সালে ভারতের সংবিধান মোতাবেক কলকাতার এক প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এফিড্যাভিটের বলে আমি যখন ‘কবীর সুমন’ নামটি নিলাম এবং নিয়ম অনুসারে পরের দিন কলকাতার দুটি বড় পত্রিকায় সেই মর্মে ঘোষণা ছাপালাম, অমনি অসংখ্য বাঙালি চিৎকার জুড়ে দিলো, ‘এই দ্যাখো, লোকটা মুসলমান, সে গাইছে ‘আমি চাই ধর্ম বলতে... ’ ইত্যাদি।
‘সুমন চট্টোপাধ্যায়’ সরাসরি হিন্দু ধর্মীয় নাম। পদবিতেই রয়েছে তার প্রমাণ। ‘কবীর সুমন’ নামটিতে ধর্মের চিহ্ন বা ইংগিত কোথায়? সংবিধান অনুসারে ‘কবীর’ আমার প্রথম নাম। ‘সুমন’ আমার পদবি। কবীর নামটি অমুসলিমরাও ব্যবহার করে থাকেন। এ তো সর্বজনবিদিত। আমার এক পরিচিত সংরাইটার গায়কের নাম ‘কবীর চট্টোপাধ্যায়’। তাঁকে কি বাঙালিরা মুসলমান বলেন? আমার গানের দুটি লাইন, আমার নেওয়া নাম ইত্যাদি নিয়ে বাঙালির কথা আর থামতে চাইছে না। আমায় ভণ্ড বলে সুখ পেতে চান পান। ভালো হয় যদি আমার বাড়িতে একদিন এপয়েন্টমেন্ট করে আসেন, কথা বলেন। আমি বেঁচে আছি, থাকবো বাংলা খেয়ালের জন্য। রিয়াজ, রচনা আর শিক্ষকতার বাইরে একটু সময় আছে। একে একে নয়, ধরুন ৫/৬ জনের দল বানিয়ে আসুন। ভিডিও করতে পারেন। আমি অরক্ষিত অবস্থাতেই থাকি। ভয়ের কিছু নেই। ৩০/৪০ মিনিট সময় দেবো। আসুন যারা চান। শুধু বোকার মতো ভাববেন না আপনাদের ফেসবুকবুকনিতে আমি টলে যাবো বা আমার সম্পর্কে সকলের মত টলে যাবে।
আপনাদের অধিকাংশেরই তেমন কোনও অবদান নেই যে আপনাদের মনে রাখবে বাংলাভাষীরা। আমায়, আমার কাজগুলোকে মনে রাখবে কেউ কেউ। আমার বাঁধা গান অনেকে গাইবে। যারা আমায় গাল দিয়ে যাচ্ছেন, আমার দোষ ধরছেন যেকোনও একটি বিষয়ে প্রকৃত উৎকর্ষ অর্জন করে দেখিয়ে দিন। ইংরিজিতে ংপধঃড়ষড়মু নামে একটি বিষয় আছে। বিষ্ঠাতত্ত্ব। আপনারা, আমার বিষ্ঠাভোগীর দল, সেই বিষয়ের চর্চায় সুখী। তাই হোন ও থাকুন। প্রাপ্য পুষ্টিই পাচ্ছেন। চমৎকার। এর আগে আমি ঠিক করেছিলাম আমার মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন কোনও হাসপাতালে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত পাল্টেছি সম্প্রতি। আমি চাই কলকাতার মাটিতে যেন আমায় কবর দেওয়া হয়। কলকাতার চেয়ে বেশি ভালো কাউকে বাসিনি।
মৃত্যুর আগে একবার আমার জন্মস্থান কটকে যেতে চাই, আমার কাঠজুড়ি নদীর ধারে। যদি সেখানেই মরি খুব ভালো। কিন্তু আমায় কবর যেন দেওয়া হয় কলকাতার গোবরায় আম-মুসলমানদের সমাধিস্থলে। আমার বাড়িতে থেকে যারা আমায় বাঁচতে সাহায্য করেন তাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্ক আমার নেই। ওসব অনেক দেখেছি। বুঝে গেছি। আমার এই স্বজনদের আমি বলে যাচ্ছি কলকাতার কোনো সংস্থায় ফোন করলে তারাই আমায় নিয়ে যাবেন, আমায় মাটি দিয়ে দেবেন আরও অনেকের সঙ্গে। কলকাতার মাটিতে মিশে থাকব আমি। ইনশাল্লাহ্! পুনশ্চ: যারা আমায় কবীর বলে ডাকতে পারছেন না পারবেন না, কেবল ‘সুমন’ বলে যাচ্ছেন তারা আমার সঙ্গে কথা বলবেন না, গায়ে যদি মানুষের রক্ত থাকে। সুমন আমার পদবি। খোদা আপনাদের মনে শান্তি দিন। ১৯/জি, বৈষ্ণবঘাটা বাই লেন, কলকাতা ৪৭। লেখক: গীতিকবি ও সংগীতশিল্পী