দেবদুলাল মুন্না: সলিমুল্লাহ খান। উদ্ধৃতি ছাড়া কথা বলেন না। সন, তারিখ বলে দিতে পারেন। স্মরণশক্তি ভালো। বিশ্লেষণ ভালো। সবাই এসব জানেন। কিন্তু তিনি যখন গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেলেন তখন সত্যের সঙ্গে অল্প মিথ্যা (দরকারে) বলাও শুরু করলেন। পাঁচটি উদাহরণ দেবো। [১] শেক্সপিয়র প্রসঙ্গ : সলিমুল্লাহ খান কয়েকদিন আগে বলেছেন, কলকাতায় শেক্সপিয়র সরণি আছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা নাকি শেক্সপিয়র অনুবাদ করতে পারেননি এবং তাদের তিনি গোটা সম্প্রদায় ধরে ‘গর্দভ’ বলেছেন। সাহিত্যচর্চায় বাংলাদেশ এগিয়ে, এখন এটা সত্য। পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছিয়ে, এটাও সত্য। কিন্তু আগে ও পরে শেক্সপিয়র অনুবাদ হচ্ছে পশ্চিবঙ্গেই বেশি, এটাও সত্য। আগে তুলিকলম প্রকাশনী থেকে পাঁচ খণ্ডে শেক্সপিয়র রচনাবলীও বেরিয়েছে, ১৯৮৭ সালে সুধাংশুরঞ্জন ঘোষের অনুবাদে। সম্প্রতি উৎপল নন্দীর অনুবাদ বেরিয়েছে দে’জ থেকে। এখন কথা হলো, শেক্সপিয়র অনুবাদ হয়নি অর্থে যদি বলেন তবে প্রশ্ন, আমাদের দেশে কারা ভালো করেছেন? ‘শেক্সপিয়র সরণি আছে’ এটা বলে সলিমুল্লাহ যদি কলকাতার ব্রিটিশ হ্যাংওভার বোঝান, তাহলেও তো তিনি শেক্সপিয়রের অনুবাদ প্রসঙ্গ তোলে নিজেও যে হ্যাংয়ে ভুগছেন সেটারই প্রমাণ দিলেন।
[২] মাদ্রাসা : সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষাকে নকল করে ইউরোপের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ ইউরোপের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা, সিস্টেম, পরীক্ষা পদ্ধতিÑ সবকিছু এসেছে মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে’। তিনি রেফারেন্স হিসেবে বলেছেন, এডওয়ার্ড সাইদের লেখার মাধ্যমে জেনেছেন জর্জ মাকদিসির দুটি বই সম্পর্কে যেখানে মাদ্রাসার কথা বলা হয়েছে। মাকদিসির বই দুটো হলো, The Rise of Colleges: Institutions of Learning in Islam and the West Ges The Rise of Humanism in Classical Islam and the Christian West: With Special Reference to Scholasticism। জর্জ আব্রাহাম মাকদিসি একজন খ্যাতনামা প্রাচ্য গবেষক ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ও প্রাচ্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। মাকদিসির দু’টো বইয়ের মধ্যে ঞযব জরংব ড়ভ ঈড়ষষবমবং বইটির কোথাও মাদ্রাসা প্রসঙ্গে খান যা বলেছেন সেসব নেই। মাকদিসির বইতে খানের ঠিক উল্টো বক্তব্য আছে। যেমন: ' The Rise of Colleges' eB‡qi PZz_© Aa¨vq 'Islam and the Christian Wes' G 224 c„ôvq G gvKw`wm wj‡L‡Qb, 'The university is a form of social organiæation produced in the Christian West in the second half of the twelfth century. As such, it was not the product of the Greco-Roman world. Nor did it originate from the cathedral or monastic schools which preceded it; it differed from them in its organiæation and in its studies. The works of H. Denifle and H. Rashdall have made this quite clear. Furthermore, the university, as a form of organiæation, owes nothing to Islam. Indeed, Islam could have nothing to do with the university as a corporation'. (Makdisi, p. 224). অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় যে ধরনের সামাজিক সংগঠন বা কর্পোরেশন তার সাথে ইসলাম ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এটি পুরোপুরি দ্বাদশ শতকে পশ্চিমা খ্রিস্টানদের দ্বারা তৈরি। বইয়ের আরো বিভিন্ন জায়গায় মাকদিসি উল্লেখ করেছেন,the concept of the university as a corporation was foreign to Islam...' (e.g. p. 237).
এছাড়া মাকদিসি Studia Islamica" জার্নালে প্রকাশিত তার Madrasa and University in the Middle Ages প্রবন্ধে পরিস্কারভাবে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে ইউরোপে গড়ে উঠেছে এবং কেন মুসলিমদের হাতে তা হয়নি। কর্পোরেশনের যে গঠনতন্ত্র তা ইসলামী আইনে স্বীকৃত নয় এবং এমন কোন ধারণাও ইসলামে নেই যার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে পারে। আসুন কিছু অংশ পড়ি: There is another fundamental reason why the university, as it developed in Europe, did not develop in the Muslim East. This reason is to be found in the very nature of the corporation. Corporations, as a form of social organiæation, had alreadz developed in Europe. Their legal basis was to be found in Roman Lwa which recogniæed juristic persons. Islamic law, on the other hand, does not recogniæe juristic persons. It recogniæed the physical, natural person as the only juristic person; and therefore, a corporation, as a fictitious legal person, as an entity with interests recogniæed and secured by the law, as a group which, in the contemplation of the law, has an existence independent of its individual members, such an entity is totally foreign to Islamic lwa and to the Islamic experience in the middle ages. (Madrasa and University in the Middle Ages, Studia Islamica, No. 32, 1970, pp. 255–264) মাকদিসি বলেছেন, ইউরোপে দ্বাদশ শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন পশ্চিমা খ্রিস্টানদের হাতে ‘কর্পোরেশন’র কনসেপ্টে গড়ে ওঠে তখন দরিদ্র ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেমন অক্সফোর্ডের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে পড়ার কোনো সুযোগ ছিলো না। আমরা সবাই জানি অক্সফোর্ড, এমআইটিতে এখনও গরিবের পোলাপান ফুল স্কলারশিপ পেলেও বাকি যে খরচ বহন করতে হয় সেটার অভাবে পড়তে পারে না। মাদ্রাসা দ্রুত পতনের মূল কারণ হিসেবে মাকদিসি বলেছেন, ইসলামী বিশ্বে মানুষের চিন্তা ও বাক স্বাধীনতা হরণ যাকে তিনি বলেছেন, "পষড়ংরহম ড়ভ ঃযব মধঃব ড়ভ রলঃরযধফ", সলিমুল্লাহ খান আরো একটি ভুল তথ্য দিয়েছেন। ভিডিওতে তিনি বলেছেন, নিজাম-উল-মূলক নামে একজনের অধীনে পারস্যে মাদ্রাসার সিলেবাস তৈরি হয়েছিলো এজন্য একে ‘দারসে-নিজামিয়া’ বলে। আসলে ‘দারসে-নিজামি’ তৈরি করেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতের উত্তর প্রদেশের সিহালি গ্রামের নিজামউদ্দিন সিহালভি।
[৩] আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : সলিমুল্লাহ খান কয়েকবারই বিভিন্ন ফোরামে বলেছেন, আখতারুজ্জামন ইলিয়াসের লেখা তিনি পড়তে পারেন না। বিশেষ করে ‘খোয়াবনামা’। সেটা উনার ব্যাপার। কিন্তু তিনি যখন বলেন, জনসংস্কৃতি মঞ্চের সভায় নাকি ‘কয়েকজন আলোচক-বলিলেন ইলিয়াস উত্তরাধুনিক ঔপন্যাসিক।’ তখন অবাক হতে হয়, আসর জমানোর জন্য এই উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার কেন? কারণ ওই সভায় কেউ এমন বলেননি। [৪] রবীন্দ্র বিরোধিতা : সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তিনি জানান, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয় যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু মজার ব্যাপার, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ কলকাতাতেই ছিলেন না! ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ছিলেন। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা সফর করেন ‘ঢাকাবাসী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এই দুই ব্যানারে। সেসময়ে তিনি রমেশচন্দ্র মজুমদারকে লেখেনÑ কল্যাণীয়েষু, ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করার জন্য দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুতি হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাদের আতিথ্য ভোগ করে ওই কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। ইতি ১৬ই মাঘ ১৩৩২ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
[৫] বিদ্যাসাগর : সলিমুল্লাহ খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংস্কৃত কলেজ থেকে যারা ডিগ্রি পাস করতেন সবাইকেই বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয়া হতো। কথাটি আংশিক সত্য। কিন্তু বেশি মিথ্যা। মাত্র তিন বছরে মোট ১৩ জনকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয়া হয়েছিল এবং বাকি ১২ জন ঈশ্বরচন্দ্রকে বিদ্যাসাগর পদবিতে সম্মানিত করে নিজেদের এই পদবি ত্যাগ করেছিলেন। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক