শিরোনাম
◈ খান ইউনুসে চলছে প্রচণ্ড লড়াই : আটকা পড়েছে প্রায় ২ লাখ ফিলিস্তিনি ◈ দেশের ৮ জেলায় দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা ◈ ভালোবাসার শহর প্যারিসে বৃষ্টিভেজা রাতে শুরু হলো অলিম্পিকস ২০২৪ ◈ সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী আজ ◈ কারফিউ আরো শিথিলের সিদ্ধান্ত হবে আজ, জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ একদফা দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক বিএনপির ◈ শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কা  ◈ ডিবি হেফাজতে কোটা আন্দোলনের ৩ সমন্বয়ক ◈ কোটা আন্দোলন: ঢামেকে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীসহ তিন জনের মৃত্যু ◈ হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষ হত্যার জবাব জনগণ একদিন আদায় করে নেবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ০৪ মার্চ, ২০২৪, ০৩:৫৪ রাত
আপডেট : ০৪ মার্চ, ২০২৪, ০৩:৫৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

২ মার্চ, ঐতিহাসিক পতাকা দিবস

শামসুদ্দিন পেয়ারা

শামসুদ্দিন পেয়ারা
১৯৭১ সালের মার্চ। বাংলাদেশ তখন রাজনীতির এক উত্তপ্ত কড়াই। মাত্র আগের দিন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ৭ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরিতে। ছাত্রর, শ্রমিক, কর্মজীবী, ব্যবসায়ী কারো কাছেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আর এক মুহূর্তের জন্যও গ্রহণযোগ্য নয়। ছাত্রলীগের জঙ্গি বাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। অস্ত্রের ভাষাই হবে এখন থেকে রাজনীতির একমাত্র ভাষা। ২ মার্চ বটতলায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকা হলো। ডাকা মানে আর কী!সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে সিদ্ধান্ত, বট তলায় বাস্তবায়ন। আগের রাতে সিদ্ধান্ত হলো তখনো পর্যন্ত যেটি ছিল জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা সেটিকেই স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসেবে ওই সমাবেশে উত্তোলন করা হবে। এটা যে স্বাধীন বাংলার পতাকা হবে সেটা সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান)-এর নির্দেশে আগে থেকেই ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল। সে পতাকা উত্তোলন করবেন ডাকসুর সহ-সভাপতি আসম আব্দুর রব। 

কেন আসম রব? প্রথমত তিনি ডাকসুর ভিপি। যদিও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তখন মূলত সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন রব-শাজাহান সিরাজ-স্বপন চৌধুরি (শহিদ)সহ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী জঙ্গি গ্রুপের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন, তথাপি ডাকসুর ব্যানারটি ছিল সে সময়ে সবচেয়ে গণআকর্ষক। নৈতিক বিবেচনায় ডাকসুই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। ডাকসুর ভিপি ছাড়াও রব ছিলেন জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান এবং সিরাজুল আলম খানের অনুসারী গ্রুপের শীর্ষ নেতা। কাজেই পতাকা তাকে দিয়েই উত্তোলন করানোটাই ছিল স্বাভাবিক। পতাকা তৈরিও হয়েছিল ওই গ্রুপেরই পরিকল্পনা ও তদারকিতে। সর্বোপরি, ছাত্র লিগের যে অংশটি তখনো ৬-দফার ভিত্তিতে পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনে বিশ্বাসী (শেখ ফজলুল হক মণির অনুসারি) এবং একই সাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধি সেই অংশের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকি তখন ছাত্র লিগের সভাপতি। কাজেই তার হাতে পতাকা তুলে দেবার প্রশ্নই আসে না। 

বটতলায় সমাবেশ। সভা শুরুর অনেক আগে থেকে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় বটতলা। ওদিকে গুরুনানকশাহি গুরুদুয়ারা হয়ে ভিসির বাড়ির সামনে থেকে প্রোক্টর মোহর আলির বাসা ঘুরে কলাভবনের বারান্দা পর্যন্ত এক বিশাল জনসমুদ্র। এ অবস্থায় বটতলায় দাঁড়িয়ে পতাকা তুললে সেটা সবাই দেখতে পাবে না। অতএব তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলো আসম আব্দুর রব বটতলা থেকে নয়, কলা ভবনের দক্ষিণপশ্চিমের গাড়ি বারান্দার ছাদ থেকে পতাকা উত্তোলন করবেন। তা হলে সেটা বিশাল জন সমুদ্রের সকলের দৃষ্টিগোচর হবে। সে কথা মতো রব, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলিগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকি ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ কলাভবনের দোতলায় উঠে সেখান থেকে রেলিং টপকে গাড়ি বারান্দার ছাদে অবস্থান নিলেন। 

পতাকা তখনো সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। বেলা এগারোটার দিকে ছাত্রলিগ ঢাকা নগর শাখার সভাপতি শেখ জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে ছাত্র লিগের জঙ্গি গ্রুপের কুড়ি পঁচিশ  জনের একটি দল একটি ফ্লাগমাস্টের মাথায় পতাকাটি বেঁধে 'জয় বাংলা' স্লোগান দিতে দিতে জহুরুল হক হল থেকে বটতলার জনসমুদ্রের দিকে আসতে থাকে। জহুরুল হক হলের গেট থেকে পতাকাবাহি দলটিকে দেখতে পেয়ে জনসভা যেন গণহিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে এমন এক দৃশ্য যা কোন মানুষের পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সেদিন যারা ঐ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন কেবল তারাই তার ভেতরের আগুন দেখেছিলেন, তার উত্তাপ অনুভব করেছিলেন। তিপ্পান্ন বছর পর তার বিবরণ দেয়া অসম্ভব। যদি এক লাখ মানুষ থেকে থাকতেন তা হলে ওই এক লাখের প্রত্যেকে ছিলেন অগ্নুদ্গীরণরত এক একটি জীবন্ত মানবাগ্নেয়গিরি। গগনবিদারী স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ পুরো এলাকা থর থর করে কাঁপছিল। আমাদের শরীরে তখন মিলিয়ন ভোল্ট বিদ্যুতের উদ্দাম উম্মাদনৃত্য। প্রতিটি মানুষের মুখে গগনবিদারী স্লোগান। জয় বাংলা। তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ  বাংলাদেশ । তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ  স্বাধীন কর। তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব। 

টগবগ করে ফুটতে থাকা সেই জনসমুদ্রের ফুটন্ত জলরাশি ভেদ করে জাহিদের বাহিনী এসে কলাভবনের গাড়ি বারান্দার নিচে থামলো। জাহিদ ফ্ল্যাগ মাস্টটি ছাদের উপর দাঁড়ানো আসম আব্দুর রবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। রব সেটি সমবেত জনতার সামনে তুলে ধরলেন। তখন চারদিকে কেবল স্লোগান, স্লোগান, স্লোগান। গলা ফাটানো, কান ফাটানো, আকাশ ফাটানো স্লোগান। কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিল কলাভবনের প্রতিটি ইট, ক্যাম্পাসের প্রতিটি গাছ যেন মত্ত জনতার অংশ হয়ে একযোগে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ছে। কয়েক মুহুর্তের জন্য প্রতিটি গাছের পাতা যেন আসম রবের হাতে ওড়ানো স্বাধীন বাংলার এক একটি পতাকায় পরিণত হয়েছিল। ইতিহাস কখনো এসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে না। লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সিনিয়র সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়