ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দি নিয়ে চলছে দেশের ৬৮টি কারাগার। কারা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোয় ৪৬ হাজার বন্দির ধারণক্ষমতা রয়েছে। গত সোমবার এসব কারাগারে বন্দি ছিল প্রায় ৮০ হাজার। তাদের মধ্যে ৭৩ দশমিক ৭৫ শতাংশেরই এখনো বিচার শেষ হয়নি। এমনকি অনেক বন্দির এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজও শুরু হয়নি। সূত্র: বণিক বার্তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমিত জায়গার মধ্যে অনেক বেশি বন্দি রাখতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না কারা কর্তৃপক্ষ। এতে কারো কারো দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বিচারিক দীর্ঘসূত্রতায় এসব বন্দির বড় একটি অংশ দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারছেন না বলে মনে করেন তারা।
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৮০ হাজার বন্দির মধ্যে বিচারাধীন বা হাজতি বন্দি প্রায় ৫৯ হাজার। আর কয়েদি হিসেবে সাজা খাটছেন প্রায় ২১ হাজার বন্দি। গত বছরের ডিসেম্বরে দেশের কারাগারগুলোয় বিচারাধীন বন্দি ছিল ৫৫ হাজার, যা সে সময় কারাগারে থাকা মোট বন্দির ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে দেশের কারাগারগুলোয় বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৭০, যা মোট বন্দির ৭৪ শতাংশ। বিচার চলমান বা শুরু না হওয়া এসব বন্দি কারাগারে হাজতি হিসেবে থাকেন। প্রথমে আমদানি ওয়ার্ড এবং পরে অন্যান্য ওয়ার্ডে তাদের স্থানান্তর করা হয়। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসব বন্দি কারা অভ্যন্তরে কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেন না। উল্টোদিকে সাজা কার্যকর হওয়া কায়েদি বন্দিরা কারা অভ্যন্তরে নানা উপার্জনমুখী কাজে যুক্ত হতে পারেন। এসব ক্ষেত্র থেকে আয়ের টাকা পরিবারের কাছেও পাঠাতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারাধীন বন্দিদের বলা হয় হাজতি। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের কয়েদি হিসেবে সাজা কার্যকর করা হয়। আর নির্দোষ প্রমাণ হলে মুক্তি পান। তবে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও মুক্তি পাওয়া একজন বন্দিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কেউ একবার কারাগারে গেলেই ধরে নেয়া হয় তিনি অপরাধী, দাগি আসামি। ফলে তিনি নিজে ও তার পরিবারের সদস্যরা সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে থাকেন। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বন্দিদের বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। বন্দি দোষী সাব্যস্ত হলে তার সাজা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তার সাজার জন্য পরিবার যেন হয়রানির শিকার না হয় তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার প্রভাব কারাগারগুলোতে পড়ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কারাগারে যেসব বন্দি রয়েছেন, তাদের বড় একটি অংশ বিচারাধীন। এমনকি এর মধ্যে বড় একটি অংশের আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজ শুরুই হয়নি। কারাগারগুলোর যে ধারণক্ষমতা, তার চেয়ে অনেক বেশি বন্দি রয়েছে। একজন বন্দির কারাবাসের ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম অধিকার রয়েছে, তা অতিরিক্ত বন্দির জন্য উপেক্ষিত হচ্ছে। একটি দেশের বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তসহ বিচারিক কাজগুলো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে যে ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয়, সেই ধাপগুলো বিলম্বিত হচ্ছে। এর প্রভাব কারাগারগুলোয় পড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কারা কর্তৃপক্ষ যেখানে বন্দির থাকারই জায়গা দিতে পারছে না, সেখানে তার অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করতে অবশ্যই হিমশিম খাবে এটাই স্বাভাবিক। বছরের পর বছর মামলা পরিচালনার যে সংস্কৃতি আমাদের দেশে রয়েছে সেটা বন্ধ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যথাযথ ধাপ অনুসরণ করে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারাগারে বন্দি রেখে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এজন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করে অপরাধীকে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিচারাঙ্গনের সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের একটি অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাবন্দিদের তথ্য সংবলিত আন্তর্জাতিক অনলাইন ডাটাবেজ ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফ (ডব্লিউপিবি) ২০২৩ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের কারাগারের ধারণক্ষমতা নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সালে দেশের কারাগারগুলোয় বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দির সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৩৬৮, যা মোট কারাবন্দির ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ। সে হিসাবে দেশের প্রতি লাখ মানুষের ৩৪ জনই তখন বিচারের অপেক্ষায় কারাবন্দি ছিল। ২০০৩ সালে কারাগারগুলোয় বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দি ছিল ৪৫ হাজার ১৭৩ জন, যা মোট বন্দির ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ।
বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দির সংখ্যা ২০০৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ হাজার ৩৫৪, যা ওই বছরের মোট বন্দির ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ। ওই বছর প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দি ছিলেন ৩৩ জন। ২০১০ সালে কারাগারগুলোয় মোট বন্দির ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ বা ৫০ হাজার ৫৭৬ জন বিচারের অপেক্ষাধীন ছিলেন। বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দির সংখ্যা ২০১৫ সালে আরো বেড়ে ৫২ হাজার ৮৭৬-এ দাঁড়ায়, যা মোট বন্দির ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই বছরগুলোয় প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে ৩৩ জন কারাবন্দি ছিলেন সাজা ছাড়াই। আর ২০২২ সালে বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দি ছিলেন ৬১ হাজার ৩৬৭ জন, যা মোট কারাবন্দির ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ওই বছর দেশের জনসংখ্যার প্রতি লাখের বিপরীতে বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে আটক ছিলেন ৩৫ বন্দি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কারাগারগুলোয় অনেক বন্দি রয়েছেন, যাদের আইনি সেবা পাওয়ার সামর্থ্য নেই। দিনের পর দিন তাদের কারাগারেই কাটাতে হয়। এসব বন্দিকে খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় আইনি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কোনো বন্দি বিনা কারণে কারাগারে রয়েছেন কিনা, কারা কর্তৃপক্ষকে তা নিয়মিত যাচাই করে দেখতে হবে। তবে সবকিছুর আগে তাদের জন্য বিচার প্রক্রিয়া সহজ করা জরুরি।
ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি থাকায় কারাগারগুলোয় মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন গুম তদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বন্দিদের দেখভালের দায়িত্ব থাকে কারা কর্তৃপক্ষের ওপর। আইন অনুযায়ী একজন বন্দির বাসস্থান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু যখনই কারাগারগুলোয় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বন্দি থাকে, স্বাভাবিকভাবে তখন বন্দিরা প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা পান না। এটা মানবাধিকার হরণ। এখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সব বন্দির জন্যই প্রাপ্য সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’
ধারণক্ষমতার অধিক বন্দি থাকলেও তাদের প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে জানান সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মো. জান্নাত-উল ফরহাদ ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে ৪৬ হাজার ধারণক্ষমতার বিপরীতে বন্দি রয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার। অতিরিক্ত বন্দি থাকলেও তাদের আবাসন, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবায় কোনো ঘাটতি নেই। বন্দি হিসেবে আইনে উল্লেখিত সব সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্য নিশ্চিত করা হচ্ছে।’