এল আর বাদল : বাংলাদেশে গুম সংক্রান্ত 'মানবতাবিরোধী অপরাধের' মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ১৫ জন কর্মরত কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একযোগে এতজন সেনা কর্মকর্তাকে সিভিল (বেসামরিক) আদালতে বিচারের ঘটনা বিরল।
এরপর থেকে সিভিল আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচার, সরকার-সেনা সম্পর্ক এবং সেনাবাহিনীতে এর প্রভাব কেমন হবে তা নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। --- বিবিসি বাংলা
শনিবার ১৫ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেয়ার ঘটনার পর সেনাবাহিনীকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের গুজব, আলোচনা এবং এই প্রক্রিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণায় সয়লাব ছিলো সামাজিক মাধ্যম।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি কৌশলী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে আর অন্যরা অনেকেই এ বিষয়ে চুপ থাকার কৌশল নিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, আগামী কয়েকদিনে এ ঘটনার গতি প্রকৃতি আরও পরিষ্কার হবে। মূলত এরপরই চূড়ান্তভাবে এসব কর্মকর্তার বিষয়ে সেনাবাহিনীর মনোভাব পরিষ্কার হবে।
একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলছেন, এ ঘটনাটি যেভাবে জনসম্মুখে প্রচার করা হয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেখা যেতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
আবার কেউ কেউ বলছেন, গত বছর ৫ই অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশে 'মানবতাবিরোধী অপরাধের' বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অভিহিত থাকায় এই ঘটনায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর কোনো ক্ষতি হবে না বলেই তারা মনে করেন।
অন্যদিকে বেসামরিক আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচার নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠলেও ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আজ এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, গুমের দুই মামলাসহ তিন মামলায় পরোয়ানাভুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিচার করার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।
অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা কি সেনা হেফাজতে থাকবেন নাকি অন্য আসামিদের মতোই তাদের বিবেচনা করা হবে – এ নিয়েই যে গুঞ্জন চলছে সে বিষয়ে মি. ইসলাম বলেছেন, "আইনের সাধারণ বিধান হচ্ছে আসামি গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়। এরপর সিদ্ধান্ত নেবেন আদালত। আসামিরা কোথায় থাকবে সেটি আদালত নির্ধারণ করবে"।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ডঃ শাহদীন মালিক বলছেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ অতীতের উদাহরণ পর্যালোচনা করে তিনিও মনে করেন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার প্রক্রিয়া ট্রাইব্যুনালে অগ্রসর হতে বাধা নেই।
ওদিকে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসকে- প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর আর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কোনো পরিকল্পনা নেই।
এই ঘটনার তাৎপর্য বা প্রভাব কেমন হবে
ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর যেসব সেনা কর্মকর্তাকে সেনা সদর হেফাজতে নেয়ার কথা জানিয়েছে, তাদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল, সাত জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এক জন কর্নেল, চার জন লেঃ কর্নেল ও এক জন মেজর রয়েছেন। আর এক জন অবসরপ্রস্তুতিকালীন ছুটিতে আছেন।
শনিবার সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মোঃ হাকিমুজ্জামান জানিয়েছিলেন যে, দুটি মামলার ৩০ জন আসামির মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে নয় জন অবসরপ্রাপ্ত, একজন এলপিআরে গেছেন এবং বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ১৫ জন।
এর আগে ৮ই অক্টোবর 'মানবতাবিরোধী অপরাধের' অভিযোগে সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাদের ২২শে অক্টোবরের মধ্যেই ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এরপর থেকেই 'সেনা কর্মকর্তাদের বেসামরিক আদালতে বিচারের' ইস্যুতে পক্ষে বিপক্ষে প্রচার-প্রচারণা, আলোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়।
সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, সামরিক আইনেই যে কোনো ধরনের অপরাধের বিচারের সুযোগ রয়েছে এবং সে কারণেই তারা কেউ কেউ মনে করেন বিষয়টি যেভাবে জনসম্মুখে আনা হয়েছে তা সামরিক বাহিনী মর্যাদা ও সম্মানের সাথে যায়নি।
সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এই বাহিনীর কেউ কোনো অপরাধ করলে এবং সেটি তদন্ত আদালতে প্রমাণিত হলে তার বিচারের সুযোগ বাহিনীতে আছে। বিষয়টি এভাবে জনসম্মুখে আসার আগে এ বিষয়ক সব বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত ছিলো। সেনাবাহিনীর সম্মান ও মর্যাদার বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা দরকার," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম।
মি. ইসলামের সশস্ত্র বাহিনীতে থাকার সময় সামরিক আদালতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তার মতে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে অবদান রেখে সশস্ত্র বাহিনী যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছে সেখানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এই ঘটনা।
আলোচনায় আগের কিছু ঘটনা
সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর নামে-বেনামে যেসব বিতর্ক হচ্ছে তাতে পুরনো কিছু ঘটনাও উঠে আসছে।
বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক ও পরে সেনা প্রধান থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে রাষ্ট্রপতি হওয়া জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক আদালতে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিলো।
এ ঘটনায় তখনকার একদল সিনিয়র আইনজীবী উচ্চ আদালতে বিষয়টি উত্থাপনের চেষ্টা করলে তখন আদালত এটিকে শুনানির জন্যই আমলে নেয়নি বলে জানিয়েছেন একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
"আদালত তখন পরিষ্কার বলেছিলো যে এটা সামরিক আদালতের বিষয়। এই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত নয় এটি," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ওই সাবেক কর্মকর্তা।
এর আগেও পাকিস্তান আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শামসুজ্জোহা হত্যাকাণ্ডের পর তখনকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এক চিঠির পর ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সাথে দেখা করে শামসুজ্জোহা হত্যাকাণ্ডের জন দায়ী সামরিক কর্মকর্তাদের সিভিল কোর্টে বিচারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তখন আইয়ুব খান তাদের বলেছিলেন যে সামরিক কর্মকর্তাদের সিভিল আদালতে বিচারের সুযোগ নেই।
তবে বাংলাদেশেই আবার সাম্প্রতিক কালে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সাধারণ আদালতেই হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সেনাকর্মকর্তাদের হত্যার বিচারও বেসামরিক আদালতে হয়েছে।
আবার আওয়ামী লীগ আমলেই সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসকে হত্যা চেষ্টা মামলায় পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে সামরিক আদালতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, পেশাগত কাজের সময় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য কোনো অপরাধ করলে তার সামরিক আইনে বিচার হবে।
"সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য পেশাগত কাজ করতে গিয়ে যদি কোনো অপরাধ করেন, তাহলে সেটি সামরিক আইনে বিচার হবে। কিন্তু যদি সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করেন, তখন তার বিচার সাধারণ আদালতে হতে কোনো বাধা নেই। ইতোপূর্বে এ ধরনের বিচারের একাধিক নজির রয়েছে।