শিরোনাম
◈ আমদানি-রপ্তানি বন্ধে বাণিজ্য, রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ◈ এবার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখবে জনগণ : তারেক রহমান ◈ দুই প্রকল্পে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা দিলো বিশ্বব্যাংক ◈ বাংলাদেশসহ একাধিক দেশে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে চীনের আগ্রহ: যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন ◈ অন্তর্বর্তী সরকারের সংকট কাটলো নাকি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো ◈ ঈদুল আজহার ছুটিতে যে তিন দিন ব্যাংক খোলা থাকবে ◈ কসবা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি যুবক আহত ◈ ক্রিকেট ধারাভাষ্য দিয়ে ম্যাচ প্রতি কত আয় ক‌রেন তারা? ◈ সি‌রিজ খেল‌তে পাকিস্তানে পৌঁছেছে বাংলা‌দেশ দ‌লের একাংশ ◈ ‌রেকর্ড, সাকিবকে টপকে গে‌লেন মুস্তা‌ফিজ

প্রকাশিত : ২৫ মে, ২০২৫, ০৫:২৫ বিকাল
আপডেট : ২৫ মে, ২০২৫, ১০:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যেভাবে দেশ ছেড়েছেন

ডেইলিস্টারের প্রতিবেদন।। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি নির্বিঘ্নে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে চুপিসারে থাইল্যান্ডের পথে রওনা হন।

নিরাপত্তা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পেয়েছে, আবদুল হামিদের গাড়ি ৮ মে রাত ১২টা ৪৬ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের ব্যারিয়ার গেটে পৌঁছায়।

বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি বিভাগের এক অপারেটর গাড়িটি থামান। যাত্রীর পরিচয় পেয়ে তিনি তার স্টেশনে ফিরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় তার পেছনে দুজন দৃশ্যমান হন—একজন হালকা গোলাপি শার্ট পরিহিত এবং অন্যজন নীল শার্ট ও ধূসর ব্লেজার পরিহিত ছিলেন। তারা গাড়িটিকে ভেতরে আসার জন্য ইশারা করেন।

এর তিন মিনিট পরে রাত ১২টা ৪৯ মিনিটে ওই দুই ব্যক্তি সামনে এগিয়ে আসেন। গোলাপি শার্ট পরিহিত ব্যক্তি সরাসরি গাড়ির কাছে যান। ব্লেজার পরিহিত ব্যক্তির কোমরে ঝুলন্ত একটি আইডি কার্ড দেখা যায়।

আবদুল হামিদকে বোর্ডিংয়ের জন্য হুইলচেয়ারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ভিডিও থেকে নেওয়া

একাধিক এভিয়েশন নিরাপত্তা কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই দুই ব্যক্তি একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। তবে তাদের মুখ ভিডিওতে স্পষ্ট না হওয়ায় দ্য ডেইলি স্টার বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।

গেট অপারেটর দ্রুত ব্যারিয়ার উঠিয়ে দিলে গাড়িটি ভিআইপি টার্মিনালের ড্রপ-অফ/পিক-আপ পয়েন্টে প্রবেশ করে।

শারীরিকভাবে দুর্বল আবদুল হামিদ লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছিলেন। তাকে একটি হুইলচেয়ারে বসানো হয়। পেছনে তার ছেলে ব্যারিস্টার রিয়াদ আহমেদ দুটি ছোট ট্রলি সুটকেস বহন করছিলেন। আবদুল হামিদ লুঙ্গি ও স্যান্ডেল পরে রাত ১২টা ৫১ মিনিটে টার্মিনালে প্রবেশ করেন।

গত ১৫ মে রিয়াদ ফেসবুকে লেখেন, তার বাবা এতটাই দুর্বল যে তিনি দুই মিনিট দাঁড়াতে বা দুই ঘণ্টার বেশি বসে থাকতে পারেন না। তার ওজন কমে এখন মাত্র ৫৪ কেজি হয়ে গেছে। কোনো প্যান্ট তার আর ফিট হয় না বলে লুঙ্গি পরতে হচ্ছে।

২১ মে ব্যাংকক থেকে দ্য ডেইলি স্টারকে রিয়াদ বলেন, 'ডাক্তাররা তার (আবদুল হামিদের) ডান ফুসফুসে ক্যানসার শনাক্ত করেছেন। আরও কয়েকটি জায়গায় সন্দেহজনক স্পট পাওয়া গেছে। সেসব স্থান থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে গতকাল (২০ মে) বায়োপসি করা হয়েছে ক্যানসার কিনা তা পরীক্ষার জন্য। একই সঙ্গে আরেকটি পরীক্ষা করা হয়েছে—তিনি অস্ত্রোপচারের ধকল সহ্য করতে পারবেন কি না, তা জানার জন্য। তিনি সুস্থ নন। দুর্বলতা আরও বেড়েছে। ২৪ মে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেবেন, তাকে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নিতে হবে কিনা।'

শাহজালাল বিমানবন্দরে টার্মিনালের ভেতরে ঢোকার পর আবদুল হামিদকে টার্মিনাল-সংলগ্ন স্ক্যানিং এরিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নিয়ম অনুযায়ী ভিআইপি লাউঞ্জে বসানো হয়।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ভোররাত ২টা ২১ মিনিটে তাকে হুইলচেয়ারে করে পুলিশ ইমিগ্রেশন ডেস্ক অতিক্রম করে গেট-৩৩-এর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

আবদুল হামিদকে বোর্ডিংয়ের জন্য ৩৩ নম্বর গেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ভিডিও থেকে নেওয়া

বিমানবন্দরের সদ্যবিদায়ী নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে দ্য ডেইলি স্টার গেট নম্বর নিশ্চিত করেছে। তিনি সেদিন রাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এবং পরদিন পদত্যাগ করেন।

তবে প্রক্রিয়াগত একটি অনিয়ম ঘটেছে—ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে সরাসরি গেট-৩৩-এ যাওয়া কোনো যাত্রীর জন্যই স্বাভাবিক নয়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ বলেন, 'গেট-৩৩ শুধুমাত্র নিরাপত্তা সংস্থার কর্মীদের জন্য নির্ধারিত। ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে যাত্রীরা দ্বিতীয় তলায় যান। সেখানে তাদের নিরাপত্তা চেকিং করা হয়।'

এই নিরাপত্তা চেকিংয়ের সময় তাদের শরীর ও হ্যান্ড লাগেজের পূর্ণাঙ্গ স্ক্যান করা হয়। সারাবিশ্বের প্রতিটি প্রধান বিমানবন্দরে ডিউটি-ফ্রি ও বোর্ডিং জোনে প্রবেশের আগে এটা করা হয়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই নিরাপত্তা যাচাই করা হয় বোর্ডিংয়ের ঠিক আগেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র এক বিমানবন্দর কর্মকর্তারা জানান, কেবল রাষ্ট্রপ্রধান ও বর্তমান রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে এই চেকিং করা হয় না।

নিরাপত্তা চেকিংয়ের পর সাধারণত যাত্রীদের বোর্ডিং ব্রিজের মাধ্যমে বা উড়োজাহাজ দূরে পার্ক করা থাকলে 'আলফা' নামে পরিচিত একটি গেট থেকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন।

তবে সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, আবদুল হামিদকে ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে সরাসরি গেট-৩৩-এ নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার নিরাপত্তা চেকিং করা হয়নি।

থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইট টিজি৩৪০ টার্মিনাল থেকে দূরে পার্ক করা ছিল।

রিয়াদের ভাষ্য অনুযায়ী, আবদুল হামিদকে একটি গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে হুইলচেয়ারসহ উড়োজাহাজে উঠানো হয়।

ভিআইপি লাউঞ্জের ভেতরে
ভিআইপি লাউঞ্জে আবদুল হামিদ যে ৯০ মিনিটের মতো ছিলেন, তখনই তার ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। একটি ফাঁস হওয়া—যা পরে যাচাই করা হয়েছে—সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এন্ট্রি থেকে জানা যায়, তার আগমনের বিষয়টি টার্মিনালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমিগ্রেশন পুলিশের অফিসার ইনচার্জকে অবহিত করেছেন।

জিডির তথ্য অনুযায়ী, সেই অফিসার ইনচার্জ ইমিগ্রেশন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফ দুটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে বিষয়টি অবহিত করেন—জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) একজন সহকারী পরিচালক ও সশস্ত্র বাহিনী গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) একজন গ্রেড-১ কর্মকর্তাকে।

তিনি ইমিগ্রেশন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজির সঙ্গেও যোগাযোগ করেন।

বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এনএসআইয়ের সহকারী পরিচালক চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী এ বিষয়ে অনুমতি চেয়েছিলেন।

এসব ঘটনার পর তাহসিনা আরিফকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসান চৌধুরীকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নাম কিশোরগঞ্জে হত্যা মামলা রয়েছে, যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

তাহসিনা আরিফ বলেন, তিনি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তার কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, 'আমি এনএসআই ও ডিজিএফআই উভয় সংস্থা থেকে অনুমতি নিয়েছি এবং 'নো-ফ্লাই' তালিকাও যাচাই করেছি। তার নাম সেখানে ছিল না। আমি আমার ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি অবহিত করেছি এবং তারা আমাকে বলেছেন তাকে যেতে দেওয়ার জন্য। আমি নিজেই ইমিগ্রেশন ডেস্কে নেমে যাই, যাতে সব প্রয়োজনীয় অনুমতি নিশ্চিত করা যায়।'

আবদুল হামিদকে বোর্ডিংয়ের জন্য ৩৩ নম্বর গেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ভিডিও থেকে নেওয়া

নিরাপত্তা ফুটেজে দেখা যায়, আবদুল হামিদকে হুইলচেয়ারে নেওয়ার সময় তাহসিনা আরিফ তার সাব-ইন্সপেক্টরদের সঙ্গে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে উপস্থিত ছিলেন।

দ্য ডেইলি স্টার এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ থেকে প্রত্যাহারকৃত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসান চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি কেবল নিজ কর্মস্থলে ফেরার জন্য শুভানুধ্যায়ীদের দোয়া কামনা করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আজহারুল ইসলাম এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সহকারী প্রশিক্ষণার্থী উপ-পরিদর্শক মো. সোলায়মানকেও বরখাস্ত করা হয়েছে।

আবদুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে তদন্তের জন্য ২০২৫ সালের ১১ মে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার এবং সদস্য পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। আগামী সপ্তাহে এই কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়