অবশেষে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে বিরোধ মেটাতে আলোচনায় বসতে রাজি আদানি
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) বিতর্কিত ধারাগুলোর সমাধানের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) প্রস্তাব দিয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ার লিমিটেড।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিপিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে এক বৈঠকে আদানি পাওয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেরসিং বি খিয়ালিয়া এই প্রস্তাব দেন।
ভারতের আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন ১৬০০ মেগাওয়াট গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার অনেক আগেই পিপিএর বিতর্কিত ধারাগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবি সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, আদানির প্রস্তাবের জবাবে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিপিডিবি চেয়ারম্যান বলেছেন, 'আমরা বসব, পরে আপনাদের (আদানি) জানাব।'
শনিবার টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে বিপিডিবি চেয়ারম্যান স্বীকার করেন, আদানি পাওয়ার পিপিএ নিয়ে পুনরায় আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে।
১৬০০ মেগাওয়াট গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়।
রেজাউল করিম বলেন, 'শের সিং বি খিয়ালিয়ার কথা অনুযায়ী আমরা উভয় পক্ষ (আদানি ও বিপিডিবি) পিপিএর বিরোধগুলো একসাথে বসে সমাধান করতে সম্মত হয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আদানি পাওয়ার লিমিটেড আমাদেরকে এই প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা বলেছি, ঠিক আছে, আপনাদের প্রস্তাবের ব্যাপারে আপনাকে জানাব।'
২০২৩ সালের ৭ এপ্রিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশ পিপিএর কিছু ধারা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু আদানিকে আলোচনার টেবিলে আনা যায়নি।
পিপিএ নিয়ে ফের আলোচনার এই প্রস্তাব এমন এক সময়ে এল, যখন একটি সরকারি কমিটি আদানি চুক্তিটি বিশ্লেষণ করছে এবং খুব শিগগিরই এ চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু করার কর্মপন্থার বিষয়ে বিপিডিবিকে সুপারিশ দেওয়ার কথা রয়েছে।
টিবিএস জানতে পেরেছে, পর্যালোচনা কমিটি তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে। কমিটি আদানি বিদ্যুৎ চুক্তির মূল ধারাগুলো—করছাড়, অতিরিক্ত বিলম্বিত পেমেন্ট সারচার্জ ও একতরফা কয়লার মূল্য নির্ধারণ নিয়ে দরকষাকষির জন্য সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে।
এর আগে ৯ মার্চ টিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সরকারি সংস্থাটি আদানি চুক্তির পিপিএর তিনটি ধারা নিয়ে নতুন করে আলোচনা করতে চায়।
আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিপিডিবি কবে পুনরায় আলোচনা শুরু করতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে বিপিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, 'আদানি চুক্তি নিয়ে একটি পর্যালোচনা কমিটি কাজ করছে। এখনই আদানির সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট আলোচনা হচ্ছে না। আমরা পর্যালোচনা কমিটির নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। এই সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের প্রস্তুতিমূলক কাজ করছি; তারপর আমরা আদানির সাথে নতুন করে আলোচনা শুরু করব।'
শেরসিংহ বি খিয়ালিয়ার নেতৃত্বে আদানির প্রতিনিধিদুকে বহনকারী একটি জেট বিমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর তারা সরাসরি বিপিডিবি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেন। এরপর তারা বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে নীরবে ঢাকা ছাড়েন।
দীর্ঘদিনের জটিলতা
বাংলাদেশ বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিল, আদানি পাওয়ার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর সুবিধা—যেমন কর অব্যাহতি—বাংলাদেশকে দিচ্ছে না। তার ওপর বিলম্বে পেমেন্টের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক হারে অর্থ আদায় করছে এবং কয়লার মূল্য নির্ধারণে চুক্তিভুক্ত সূচকের বাইরে অন্যভাবে হিসাব করছে।
হাইকোর্টের নির্দেশনায় গঠিত কমিটিও দেখতে পেয়েছে, আদানি চুক্তিতে কর অব্যাহতির ধারাগুলো একতরফাভাবে আদানির পক্ষেই সুবিধাজনক। আর বিলম্বে পেমেন্টের জন্য আদানি বার্ষিক ২৭ শতাংশ চার্জ করছে।
২০১৯ সালে মোদি সরকার স্পেশাল ইকোনমিক জোন (এইজেড) আইন সংশোধন করে গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এসইজেডের মর্যাদা দেয় এবং আদানিকে ২৫ বছরের জন্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কার্বন কর ছাড় দেয়। পাশাপাশি প্রথম পাঁচ বছরে শতভাগ, পরবর্তী পাঁচ বছরে ৫০ শতাংশ এবং পুনঃবিনিয়োগ করা রপ্তানি আয়ের ওপর আরও পাঁচ বছরের জন্য ৫০ শতাংশ আয়কর মওকুফের সুবিধা দেয়।
বিপিডিবির অভিযোগ, আগের নথিপত্রে বাংলাদেশকেও এসব সুবিধা দিতে সম্মত হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত চুক্তিতে ভিন্ন শব্দচয়ন ও শর্ত থাকার কারণে বাংলাদেশকে সুবিধাগুলো দেওয়া হয়নি।
২০২৩ সালের ৭ এপ্রিল আদানি পাওয়ার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে এবং ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে থাকে।
২০২৪ সালে বিপিডিবি তিনবার আদানির কাছে কর সুবিধা-সংক্রান্ত বিষয়টি তোলে—প্রথমবার ১৭ সেপ্টেম্বর, এরপর ২২ অক্টোবর এবং ফের ৪ ডিসেম্বর।
বকেয়া বিলের ক্ষেত্রে নমনীয় অবস্থান আদানির
বিপিডিবি ও আদানির প্রতিনিধিদলের বৈঠকের সময় আদানির পাওনা বিদ্যুৎ বিল নিয়েও আলোচনা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, বৈঠকে আদানি বিপিডিবির হিসাব অনুযায়ী বকেয়া বিল নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখিয়েছে এবং বিপিডিবিকে যত দ্রুত সম্ভব বকেয়া পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছে।
বিপিডিবির হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিল পর্যন্ত আদানি পাওয়ারের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫৬২.০৯ মিলিয়ন ডলার।
আদানির ঢাকা অফিসের একটি সূত্র বলেছে, অর্থ বিভাগ থেকে বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে ডিসেম্বরের মধ্যে বিল পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছে বিপিডিবি। তবে এই দাবি অস্বীকার করেছেন বিপিডিবি চেয়ারম্যান।
রেজাউল করিম বলেন, 'আমরা তাদের (আদানিকে) সমস্ত বকেয়া পরিশোধের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা দিইনি। তবে আদানি বলেছে, "আপনাদের (বিপিডিবি) পরিশোধ সিস্টেম এখন ভালো। তবে দ্রুত পরিশোধের চেষ্টা করুন, যাতে আমাদের পাওনা ব্রেক-ইভেনে চলে আসে।"
আদানির কর্মকর্তার বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিপিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, 'আমাদের পেমেন্ট অনেক দিন ধরে বকেয়া পড়ে আছে।' উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।