বিশ্বায়নের সুফল যে চীন সবচেয়ে বেশি পেয়েছে, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে দেশটিতে দিনে ৩ ডলারের (২০২১ সালের মান অনুযায়ী) কম আয়ে চলা মানুষের সংখ্যা ছিল ৯৪ কোটি ৩০ লাখ; যা ছিল দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে এসে চীন অভাবনীয়ভাবে এই সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে এনেছে।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটি উল্টো। যুক্তরাষ্ট্রের অবিরাম সাফল্যের যে গল্প শোনানো হয়, দারিদ্র্যের এই পরিসংখ্যান তার সঙ্গে ঠিক মেলে না। দেশটিতে এখন ৪০ লাখের বেশি মানুষ দিনে ৩ ডলারের কম আয়ে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। যা মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। ৩৫ বছর আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে এই অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন গুণের বেশি বেড়েছে।
এটা ঠিক যে ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা এখন অনেক বেশি। কর্মীপ্রতি উৎপাদন বা আয়ে বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশই কেবল তাদের সমকক্ষ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কল্যাণে দেশটি হয়তো আরও অনেকটা এগিয়ে যাবে। কিন্তু অর্থনীতির এত অগ্রগতির পরও দরিদ্র মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি দেশটির জন্য অস্বস্তিকরই বটে।
যুক্তরাষ্ট্র তার বিপুল সম্পদ কীভাবে খরচ করে বা কাদের পেছনে ব্যয় করে, সেই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটা সফল, তা শুধু মোট সম্পদ দিয়ে মাপা যায় না। সেই সাফল্যের সুফল সমাজের সব স্তরে কীভাবে পৌঁছাচ্ছে এবং ব্যর্থতার দায় কীভাবে মেটানো হচ্ছে, সেটাও বিবেচ্য।
দারিদ্র্যসীমার নিচে ধুঁকতে থাকা মানুষদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র বেশ পিছিয়ে। চীনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু অর্থনৈতিক উৎপাদন ছয় গুণ বেশি। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, চীনের চেয়ে 'হতদরিদ্র' মানুষের সংখ্যা এখন যুক্তরাষ্ট্রেই বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অসমতার গল্প নতুন নয়। কিন্তু আয়ের বৈষম্য যে হারে বাড়ছে, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। ১৯৮০ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যম আয়ের মানুষের উপার্জন ছিল ধনী (শীর্ষ ১০ শতাংশ) মানুষের আয়ের ৫২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো। ২০০০ সালে তা কমে ৪৮ শতাংশে নামে। আর ২০২৩ সালে এই ব্যবধান আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশে।
যুক্তরাষ্ট্রের মোট অর্থনীতিতে দরিদ্রদের হিস্যা এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর পর্যায়ে নেমে গেছে। ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ধনীরা যে হারে সম্পদ বাড়িয়েছেন, তা দরিদ্রতম ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের প্রবৃদ্ধির চেয়ে দ্বিগুণ।
পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্রতম ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশটির মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ যাচ্ছে। এই হার বলিভিয়ার দরিদ্রদের সমান। অথচ নাইজেরিয়ায় এই হার ৩ শতাংশ এবং চীনে ৩ দশমিক ১ শতাংশ। এমনকি বাংলাদেশেও জাতীয় আয়ে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ মানুষের হিস্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি—৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
এই পরিস্থিতির জন্য বাজার অর্থনীতিকে দোষ দেওয়া খুব সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈষম্য তৈরিতে বাজারের ভূমিকা অবশ্যই আছে। বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শ্রমিকের আয়ের ভাগ কমিয়ে দিয়েছে। এগুলো শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বৈষম্যকে আরও উসকে দিয়েছে। একদিকে যেমন উচ্চশিক্ষিত কর্মীরা পুরস্কৃত হচ্ছেন, অন্যদিকে অদক্ষ শ্রমিকদের হটিয়ে জায়গা দখল করে নিচ্ছে রোবট বা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলোর দিকে তাকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত চিত্রটি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তার প্রস্তাবিত 'বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট' এবং যখন-তখন শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিত্যপণ্যের দাম বাড়াবে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যবসা ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সম্পদের ভাগ না দেওয়া, মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারাটা যে মার্কিন পুঁজিবাদের কোনো অনিচ্ছাকৃত ভুল বা ত্রুটি নয়, বরং এটাই যে এই ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য—ট্রাম্পের নীতি সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
নতুন এই আইনের ফলে লাখো মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। মেডিকেইড ও 'অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট'-এর আওতায় দেওয়া ভর্তুকি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেওয়ায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসার খরচ বাড়বে বহুগুণ। এমনকি গরিবের পুষ্টি সহায়তা কর্মসূচি 'স্ন্যাপ' থেকেও শত শত কোটি ডলার কেটে নেওয়া হবে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির বাজেট ল্যাবের তথ্যমতে, ট্রাম্পের শুল্ক ও নতুন বিলের প্রভাবে আমেরিকার শীর্ষ ধনী ২০ শতাংশ পরিবার ছাড়া বাকি সবার আয় কমবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন দরিদ্রতম ১০ শতাংশ মানুষ; তাদের আয় কমবে প্রায় ৭ শতাংশ।
অবশ্য দরিদ্রদের প্রতি এই উদাসীনতা যে হুট করে ট্রাম্পের আমলে শুরু হয়েছে, তা নয়। গত ৫০ বছর ধরে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় সরকারই বাজারের দক্ষতার দোহাই দিয়ে বৈষম্যের বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে। জিমি কার্টার ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই গরিবদের চেয়ে ধনীদের আয় বেশি হারে বেড়েছে। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু বিল ক্লিনটন। আর হ্যাঁ, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও গরিবদের আয় কিছুটা বেড়েছিল, তবে তা কোনো কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে নয়, বরং করোনা মহামারির সময় দেওয়া সরকারি ভর্তুকির সুবাদে।
মজার বিষয় হলো, ট্রাম্প নিজেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন। অথচ বাস্তবে তিনি মার্কিন পুঁজিবাদের সেই পুরোনো ক্ষতকেই আরও গভীর করছেন। ট্রাম্পের 'মাগা' (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) সমর্থকরা বিশ্বব্যবস্থার সমালোচনা শুনে হয়তো হাততালি দিচ্ছেন। কিন্তু তারাও একসময় বুঝতে পারবেন—নেতার বুলি পাল্টালেও সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারায় আমেরিকার চিরাচরিত নীতি একটুও বদলায়নি।
এতো কথা বলার উদ্দেশ্য চীনের একনায়কতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন বা ভিন্নমত দমনের প্রশংসা করা নয়। কিন্তু একটি প্রশ্ন এসেই যায়—একটি অগণতান্ত্রিক সরকার যেখানে সফলভাবে তাদের দেশে দারিদ্র্য দূর করতে পারল, সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ও ধনী গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও যুক্তরাষ্ট্র কেন তা পারল না?
সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড