জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, উন্নত আবহাওয়ার সন্ধান এবং নতুন নীতির প্রভাবে স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে দেশত্যাগের প্রবণতা বাড়ছে, যা কানাডার অর্থনীতি ও শ্রমবাজারের জন্য অশনি সংকেত।বিশ্বজুড়ে অভিবাসীদের জন্য অন্যতম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কানাডা। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। রেকর্ড সংখ্যক কানাডীয় নাগরিক, স্থায়ী বাসিন্দা এবং অস্থায়ী অভিবাসী দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং সরকারি নীতির পরিবর্তন এই দেশত্যাগের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
কানাডার সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা স্ট্যাটিসটিকস কানাডা-র তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশত্যাগের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রায় ২৭,০৮৬ জন কানাডীয় নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা দেশ ছেড়েছেন, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে এই সংখ্যা আরও বাড়বে, কারণ সাধারণত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশত্যাগের হার সবচেয়ে বেশি থাকে।
একই সময়ে, অস্থায়ী বাসিন্দা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও ওয়ার্ক পারমিটধারীদের মধ্যে দেশত্যাগের হার বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। বছরের প্রথম তিন মাসে ২ লাখ ৯ হাজার ৪০০ জন অস্থায়ী বাসিন্দা কানাডা ছেড়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫৪% বেশি।
কেন মানুষ কানাডা ছাড়ছে?
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বেশ কিছু কারণে মানুষ কানাডা ছেড়ে চলে যাচ্ছে:
জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়: কানাডার বড় শহরগুলোতে বাড়ির দাম, ভাড়া এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ আকাশছোঁয়া, যা অনেক অভিবাসীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উন্নত আবহাওয়া ও জীবনধারার খোঁজ: অনেকেই কানাডার দীর্ঘ ও কঠোর শীত থেকে মুক্তি পেতে পর্তুগাল, ইতালি, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
ক্যারিয়ারের নতুন সুযোগ: উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার এবং উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবীরা যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে আরও ভালো সুযোগের সন্ধান করছেন, যেখানে ডিজিটাল নোম্যাড ভিসার মতো সুবিধা রয়েছে।
পারিবারিক কারণ: যেসব অভিবাসীর পরিবার বা সন্তান নেই, কিংবা যারা বয়স্ক (৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে), তাদের মধ্যে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সাধারণত কানাডায় অভিবাসনের ৩ থেকে ৭ বছরের মধ্যেই অনেকে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সরকারি নীতির প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কানাডা সরকারের নতুন কিছু নীতি এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। সম্প্রতি কানাডা সরকার অস্থায়ী বিদেশি শ্রমিক ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই নীতির ফলে অনেক অস্থায়ী বাসিন্দা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন, যা তাদের দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করছে।
ভবিষ্যৎ শঙ্কা
অভিবাসীনির্ভর দেশ হিসেবে কানাডার অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো অনেকাংশে কর্মক্ষম মানুষ ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ওপর নির্ভরশীল। এই দেশত্যাগের ঢেউ কানাডার জন্য দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে:
মেধা পাচার (Brain Drain): দক্ষ ও মেধাবী মানুষের চলে যাওয়ায় দেশের শ্রমবাজার ও উদ্ভাবনী খাতে শূন্যতা তৈরি হতে পারে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি: অভিবাসীরা কর প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। তাদের অনুপস্থিতিতে রাজস্ব আয় কমতে পারে।
সামাজিক স্থবিরতা: অভিবাসীদের চলে যাওয়া কানাডার বহুসাংস্কৃতিক সমাজ এবং সামাজিক গতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট মোকাবেলায় কানাডা সরকারের উচিত দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি পর্যালোচনা করা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করা। তা না হলে, অভিবাসীদের স্বপ্নের দেশ কানাডা অচিরেই স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: স্ট্যাটিসটিকস কানাডা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্লেষণ।