সিন্ধু পানি চুক্তি (Indus Waters Treaty - IWT) নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধে নেদারল্যান্ডসের হেগের স্থায়ী সালিশি আদালত (Permanent Court of Arbitration - PCA) পাকিস্তানের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। এই রায়কে পাকিস্তান নিজেদের জন্য এক বিরাট ‘আইনি বিজয়’ হিসেবে দেখছে, যা ভারতের দুটি বিতর্কিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে, ভারত এই আদালতের এখতিয়ারকে বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে এবং সর্বশেষ এই রায়ও পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪ (ভারতীয় সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, পাকিস্তানের জন্য ২৭ জুন), হেগের স্থায়ী সালিশি আদালত সিন্ধু পানি চুক্তি সংক্রান্ত বিরোধে তার এখতিয়ার নিয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। রায়ের প্রধান অংশগুলো হলো:
১. এখতিয়ার বহাল: আদালত সর্বসম্মতভাবে রায় দেন যে, এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তাদের পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে চুক্তি স্থগিত করার একতরফা সিদ্ধান্ত আদালতের বিচারিক ক্ষমতাকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করে না।
২. একতরফা স্থগিতাদেশ অকার্যকর: আদালত স্পষ্ট করে দেন যে, সিন্ধু পানি চুক্তি কোনো একটি দেশের ইচ্ছায় স্থগিত বা বাতিল করা যায় না। এই চুক্তি তখনই সমাপ্ত হতে পারে যখন ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে তা বাতিল করবে।
৩. সালিশি প্রক্রিয়া আটকানো যাবে না: রায়ে আরও বলা হয়, একবার সালিশি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে, কোনো এক পক্ষ নিজেদের সরিয়ে নিয়ে সেই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে না।
এই রায়ের ফলে ভারতের কিষাণগঙ্গা (জম্মু ও কাশ্মীর) এবং রাটল (জম্মু ও কাশ্মীর) জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নকশা ও কার্যক্রম নিয়ে পাকিস্তানের তোলা আপত্তিগুলো পর্যালোচনার পথ খুলে গেল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই রায়কে উষ্ণভাবে স্বাগত জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে:
"এই রায় পাকিস্তানের জন্য একটি বড় বিজয়। এটি প্রমাণ করে যে সিন্ধু পানি চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা শক্তিশালী এবং কোনো দেশের একতরফা পদক্ষেপে তা অকার্যকর হয় না।"
পাকিস্তান জোর দিয়ে বলেছে, ভারতের এই দাবি যে তারা চুক্তি স্থগিত করে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া থেকে সরে যেতে পারে, তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
এই রায়ের ফলে এখন সালিশি আদালত কিষাণগঙ্গা ও রাটল প্রকল্পের নকশা চুক্তির বিধান অনুযায়ী হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখবে। পাকিস্তানের মূল আপত্তি হলো, এই প্রকল্পগুলোর জলাধারের নকশা চুক্তির নির্দিষ্ট মানদণ্ড লঙ্ঘন করেছে, যা পাকিস্তানের দিকে যাওয়া নদীর পানি প্রবাহ কমিয়ে দেবে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই রায় প্রকাশের পরপরই একটি কড়া বিবৃতি দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতের মূল যুক্তিগুলো হলো:
এখতিয়ারের স্বীকৃতি না দেওয়া: ভারত শুরু থেকেই এই সালিশি আদালতের গঠনকে অবৈধ বলে আসছে। ভারতের মতে, এই আদালতের গঠন সিন্ধু পানি চুক্তিরই একটি "গুরুতর লঙ্ঘন"।
বিরোধ নিষ্পত্তির ভুল প্রক্রিয়া: ভারত চেয়েছিল, এই বিরোধ একজন "নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ" (Neutral Expert) দ্বারা সমাধান করা হোক, যা চুক্তির একটি সরল প্রক্রিয়া। কিন্তু পাকিস্তান বিষয়টিকে আরও জটিল "সালিশি আদালত" (Court of Arbitration)-এ নিয়ে যায়। ভারত মনে করে, একই বিরোধ নিয়ে দুটি সমান্তরাল প্রক্রিয়া (নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং সালিশি আদালত) চলতে পারে না, যা বিশ্বব্যাংক ভুলভাবে শুরু করেছিল।
সার্বভৌম অধিকার: ভারত দাবি করেছে, ২০১৯ সালে তারা পাকিস্তানকে একটি নোটিশ দিয়ে চুক্তি পরিবর্তনের জন্য আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিল। পাকিস্তান তাতে সাড়া না দেওয়ায় ভারত চুক্তিটি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের মতে, একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্থগিত করার এই সিদ্ধান্ত তাদের "সার্বভৌম অধিকার" (Sovereign Right)-এর মধ্যে পড়ে।
অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা: যেহেতু ভারত এই আদালতের এখতিয়ার মানে না, তাই তারা এর কোনো শুনানিতেই অংশ নেয়নি। ভারত জানিয়েছে, তারা এই "অবৈধ" আদালতের কোনো রায় মানতে বাধ্য নয়।
সিন্ধু পানি চুক্তি (১৯৬০): বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানি ভাগাভাগি করা হয়।
পূর্ব দিকের নদী: শতদ্রু (Sutlej), বিপাশা (Beas) ও ইরাবতী (Ravi) নদীর ওপর ভারতের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
পশ্চিম দিকের নদী: সিন্ধু (Indus), ঝিলাম (Jhelum) ও চেনাব (Chenab) নদীর পানি পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হয়। তবে ভারত এই নদীগুলোর ওপর কৃষি, গার্হস্থ্য ব্যবহার এবং "রান-অফ-দ্য-রিভার" জলবিদ্যুৎ প্রকল্প (যেখানে পানি আটকে রাখা হয় না) নির্মাণ করতে পারবে।
বর্তমান বিরোধের উৎস: ভারতের ঝিলাম নদীর উপনদী কিষাণগঙ্গার ওপর ৩৩০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং চেনাব নদীর ওপর ৮৫০ মেগাওয়াটের রাটল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নকশা নিয়ে পাকিস্তান আপত্তি জানায়। পাকিস্তানের দাবি, এই প্রকল্পগুলোর নকশা চুক্তির প্রযুক্তিগত শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
প্রক্রিয়াগত সংঘাত: ২০১৬ সালে পাকিস্তান এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সালিশি আদালত গঠনের আবেদন করে। একই সময়ে ভারত একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে আবেদন করে। বিশ্বব্যাংক উভয় প্রক্রিয়া শুরু করলে পরিস্থিতি জটিল হয় এবং ভারত এই সমান্তরাল প্রক্রিয়াকে চুক্তির লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে।
হেগের আদালতের এই রায় একটি প্রক্রিয়াগত বিজয় হলেও মূল বিরোধের নিষ্পত্তি এখনও বাকি। আদালত এখন প্রকল্পের কারিগরি দিকগুলো খতিয়ে দেখবে। যেহেতু ভারত এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে না, তাই আদালতের ভবিষ্যৎ রায় একতরফা হতে পারে। তবে সেই রায় ভারতের ওপর প্রয়োগ করা প্রায় অসম্ভব হবে এবং এটি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলবে। এই পরিস্থিতি সিন্ধু পানি চুক্তির ভবিষ্যৎকেই এক বড় অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিয়েছে।
সূত্র:
দ্য ডন (The Dawn), পাকিস্তান
হিন্দুস্তান টাইমস (Hindustan Times), ভারত
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Ministry of External Affairs, India)
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Ministry of Foreign Affairs, Pakistan)