ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। তবে সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল শুধু সামরিকভাবে নয়, অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত ও কূটনৈতিকভাবেও বড় বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল এখন বহুমাত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
নিচে ইরানের সঙ্গে সংঘাতে ইসরায়েলের ১০টি বড় ক্ষতি তুলে ধরা হলো:
১. বিপুল সামরিক ব্যয়: এই যুদ্ধ ইসরায়েলকে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ করতে বাধ্য করছে। ডেভিড’স স্লিং বা অ্যারো সিস্টেমের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ১ থেকে ৪ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। যুদ্ধের শুরুতে দুই দিনেই খরচ হয় প্রায় ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘমেয়াদি এই ব্যয় দেশটির অর্থনীতিতে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করছে।
২. ক্ষেপণাস্ত্র ও অস্ত্রভাণ্ডারের সংকট: ইরান এরই মধ্যে ৪০০’র বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে। ইসরায়েল প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করতে দুটি করে ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে। এতে করে ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিস্থাপন ব্যয়ও আকাশছোঁয়া।
৩. হাসপাতাল ও নাগরিক স্থাপনায় হামলা: ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের সরোকা মেডিকেল সেন্টার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এই ঘটনাকে ইসরায়েলি সরকার যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
৪. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামোর ক্ষতি: ইরানি হামলায় ইসরায়েলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট, তেল ডিপো ও গ্যাস স্টোরেজে সরাসরি আঘাত হানা হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং পরোক্ষভাবে শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
৫. বিমা খরচ ও বাণিজ্যিক অবরোধ: যুদ্ধের প্রভাবে সমুদ্রবন্দরে রপ্তানি-বাণিজ্য প্রায় থেমে গেছে। জাহাজ পরিবহনে বিমার হার তিনগুণ বেড়ে গেছে। এতে করে বাণিজ্যিক পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক লগ্নিকারীরাও সরে যাচ্ছে।
৬. স্টক মার্কেটে ধস ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা: তেল রিজার্ভ ও প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জে আঘাত হানায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক কোম্পানি অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
৭. বেসামরিক জীবন বিপর্যস্ত: হাজার হাজার মানুষকে যুদ্ধের কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, বিমান চলাচল ব্যাহত এবং নাগরিকদের মাঝে ভয় ও উদ্বেগ বাড়ছে।
৮. বাজেট ঘাটতি ও উন্নয়ন ব্যয় সংকুচিত: সরকার প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট দ্বিগুণ করেছে- ৬০ বিলিয়ন শেকেল থেকে ১১৮ বিলিয়নে (প্রায় ৩৩.৬ বিলিয়ন ডলার)। ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে সংকট তৈরি করবে।
৯. মার্কিন নির্ভরতা বাড়ছে: ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষায় এখন যুক্তরাষ্ট্রের থাড ও প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের সহায়তা নিতে হচ্ছে। কিন্তু এই নির্ভরতা ইসরায়েলকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে তুলছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ায়।
১০. দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ভয়: বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ ৩০ দিন স্থায়ী হলে ইসরায়েলের ক্ষতি ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি সাহায্য কমিয়ে দেয়, তাহলে ইসরায়েলের অস্ত্র ও রসদ ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা যুদ্ধের ফলাফলকেই পাল্টে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই সংঘাত যত দীর্ঘায়িত হবে, তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইসরায়েল। ইরানের দাবি অনুযায়ী, এখনো তারা সম্পূর্ণ অস্ত্রভাণ্ডার ব্যবহার করেনি, যদি এ দাবি সত্য হয়, তাহলে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
তথ্যসূত্র : Wall Street Journal, Washington Post, Economic Times, El País, Al Jazeera, Bloomberg, ynetnews, Israeli press briefings.