পহেলগামে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তান থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সব ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। বৃহস্পতিবার (২ মে) দেশটির পররাষ্ট্র বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) এ সংক্রান্ত একটি সরকারি আদেশ জারি করে।
আদেশে বলা হয়, '২০২৩ সালের পররাষ্ট্র বাণিজ্য নীতিতে একটি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে উৎপাদিত বা রপ্তানিকৃত সব ধরনের পণ্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আমদানি ও ট্রানজিট নিষিদ্ধ করা হলো। এ নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।'
আদেশে আরও বলা হয়, 'এই নিষেধাজ্ঞার কোনো ব্যতিক্রম ঘটাতে হলে ভারত সরকারের অনুমোদন লাগবে।'
এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় পাকিস্তান থেকে ভারতে পণ্য আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জানুয়ারির মধ্যে পাকিস্তানে ভারতের রপ্তানি ছিল ৪৪৭.৬৫ মিলিয়ন ডলার, আর আমদানি মাত্র ০.৪২ মিলিয়ন ডলার।
ওই সময়কালে পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছিল, তার মধ্যে ফল ও বাদাম ছিল ০.০৮ মিলিয়ন ডলারের, কিছু তেলবীজ ও ওষধি গাছ ছিল ০.২৬ মিলিয়ন ডলারের। এছাড়া কিছু জৈব রাসায়নিক পণ্যও আমদানি হয়েছিল।
পহেলগামে ২২ এপ্রিলের ওই হামলার পর ভারত একাধিক কঠোর পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে আছে পাঞ্জাবের আটারি সীমান্ত দিয়ে নির্দিষ্ট পণ্য চলাচল বন্ধ করে দেওয়া, পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের বহিষ্কার এবং ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা।
২০১৯ সালের পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার পর দুই দেশের কূটনৈতিক উত্তেজনার জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কার্যত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে হলেও ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয় ১১৮ কোটি ডলারের পণ্য, আর আমদানি হয় মাত্র ২৮ লাখ ডলারের পণ্য। এর আগের দুই অর্থবছরেও বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল খুবই কম। ২০২২-২৩ সালে রপ্তানি হয়েছিল ৬২৭.১ মিলিয়ন ডলারের এবং আমদানি ছিল ২০.১১ মিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ সালে রপ্তানি ছিল ৫১৩.৮২ মিলিয়ন ডলার এবং আমদানি মাত্র ২.৫৪ মিলিয়ন ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তানে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ৬০ শতাংশ ছিল জৈব রাসায়নিক ও ওষুধ–এই দুটি খাত থেকে। এ সময়ে জৈব রাসায়নিক রপ্তানি হয় ১২৯.৫৫ মিলিয়ন ডলারের এবং ওষুধ রপ্তানি হয় ১১০.০৬ মিলিয়ন ডলারের।
পুলওয়ামা হামলার পর ভারত পাকিস্তান থেকে আমদানি করা সব পণ্যে ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর আওতায় পড়ে তাজা ফল, সিমেন্ট, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ও খনিজ আকরিকের মতো পণ্যও।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে ভারতের আমদানি ছিল ৪৮৮.৫ মিলিয়ন ডলার। ওই সময় পাকিস্তান থেকে মূলত ফল ও সিমেন্ট আমদানি হতো। তবে এরপরই ভারত 'এমএফএন' (সর্বাধিক অনুকূল দেশ) মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয় এবং পাকিস্তানের পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসায়, যা কার্যত আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার শামিল।
ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-র (ডব্লিউটিও) 'সিকিউরিটি এক্সেপশন' (নিরাপত্তা ব্যতিক্রম) ধারা ব্যবহার করে পাকিস্তানের এমএফএন মর্যাদা প্রত্যাহার করে। ডব্লিউটিও-র সদস্য দুই দেশই। এমএফএন চুক্তি অনুযায়ী, কোনো সদস্য দেশকে অপর সদস্য দেশের সঙ্গে বৈষম্যহীনভাবে শুল্ক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক শর্তে আচরণ করতে হয়।
ভারত ১৯৯৬ সালেই পাকিস্তানকে এমএফএন মর্যাদা দিয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান পাল্টা সে মর্যাদা দেয়নি। ২০১২ সালে পাকিস্তান ভারতকে এমএফএন মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও দেশীয় বিরোধিতার মুখে তা থেকে সরে আসে। পরে তারা 'বৈষম্যহীন বাজার প্রবেশাধিকার' (এনডিএমএ) দেওয়ার কথা বললেও সেটিও আর কার্যকর হয়নি।
২০১৯ সালের আগস্টে পাকিস্তানও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করে দেয়, এর আগে ভারত পাকিস্তানি পণ্যের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপ করে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২.৪১ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছর ২০১৬-১৭ সালে যা ছিল ২.২৭ বিলিয়ন ডলার। ওই বছরে ভারত পাকিস্তান থেকে ৪৮৮.৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে এবং ১.৯২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।