জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া দোলা দিতেই ভোটের মাঠে আলোচনায় এসেছে দেশের বিদ্যমান ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বা জোটের বিষয়টি। তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করে ভোটে যেতে চাচ্ছে না বেশিরভাগ ইসলামি দল। এসব দলের নেতারা জোট বেঁধে ভোটে যাওয়ার ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের দলের আদর্শ ও চিন্তাধারার পার্থক্য সামনে আনছেন। কাজেই জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জোট গঠনের আলোচনা বেশ কিছু দিন ধরে শোনা গেলেও তা খুব সহজ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, এই জোট বা সমঝোতার বিষয়টি এখনো টেবিল আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ। দিন যত গড়াচ্ছে, বৃহৎ জোট বা সমঝোতা নিয়ে দেখা দিচ্ছে নানা সন্দেহ ও সংশয়। এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত সব দল মিলে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই মনে করছেন বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতারা। দলগুলোর অনেক নেতা জামায়াতের সঙ্গে জোট করবেন না-বিষয়টি এখনই প্রকাশ্যে বলতে চান না। তারা পৃথক ইসলামি জোট করার কথাও ভাবছেন। তবে জামায়াতে ইসলামী জোট করার বিষয়ে এখনো আশাবাদী। বেশ কয়েকটি দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকেই দেশে নির্বাচনের পালে হাওয়া লেগেছে। ভোটে নামার আগে সব ইসলামি দল নিয়ে একটি বৃহৎ ঐক্য করতে চাইছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। এ বিষয়ে ইসলামপন্থি বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ দলই জামায়াতের সঙ্গে জোট না করার বিষয়ে আগ্রহী।
এমন প্রেক্ষাপটে ইসলামি দলগুলোর ঐক্য প্রক্রিয়ায় সব ইসলামি দল যে জামায়াতের সঙ্গে থাকছে না, সেটা ইতোমধ্যে প্রায় স্পষ্ট হয়ে গেছে।
জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের সব শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। জামায়াতের সঙ্গে দেশের সব শ্রেণির মানুষের পূর্ণ সমর্থন আছে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে সব ইসলামি দল নিয়ে এক বৃহৎ জোটের জন্য আমরা কাজ করছি। এ বিষয়ে আলেম-ওলামা ও ইসলামি রাজনীতিকদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। নির্বাচন যত কাছে আসবে, আমাদের এ প্রক্রিয়া তত দৃশ্যমান ও সুসংগঠিত হবে।
অনেক ইসলামি দল জামায়াতের সঙ্গে জোটে যেতে চাচ্ছে না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। আরও সময় গেলে আশা করি একটি শক্তিশালী ঐক্য বা সমঝোতা দেখতে পারবেন। আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলো মিলে কমপক্ষে এক বাক্স নীতিতে সমঝোতায় আসতেই হবে বলে তিনি আশা করেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক যুগান্তরকে জানান, ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রথম থেকে থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটে যাচ্ছে না তার দল।
তিনি বলেন, নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়ে আমরা এখনো তেমন কিছু ভাবছি না। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়ে আমাদের একাধিক বৈঠক ও কথাবার্তা হয়েছে। তবে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়ে এখনো কোনো অফিশিয়াল আলোচনা আমরা করিনি। জামায়াত এবং আমাদের চিন্তার পার্থক্যটা বিরাট। মাওলানা মওদুদী সাহেবের যে চিন্তাধারা, তার সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের চিন্তাধারার পার্থক্য রয়েছে। সেটাই মূল পার্থক্য। এছাড়া জামায়াতের সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর ইসলামিক উম্মাহর চিন্তার জায়গায় পার্থক্য তো আছেই। এসব পার্থক্যের কারণে এখনো মূলধারার আলেমসমাজ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করেননি।
এদিকে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজী বলেন, মাঠপর্যায়ে জামায়াতের ব্যাপারে আলেমদের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোট সব সময় আলেমদের নিয়েই চলে। আলেমদের মতামতের বাইরে আমরা যাব না। তাছাড়া জোটগত নির্বাচনের বিষয়ে আমরা দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নিইনি।
অন্যদিকে শোনা যাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটের ব্যাপারে বেশ সক্রিয় চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। অতীতের বৈরিতা ভুলে দল দুটির মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পিআর ইস্যুতে দল দুটিকে অভিন্ন সুরে কথা বলতে দেখা গেছে। এটা ঐক্যপ্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে কারও কারও ধারণা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, চরমোনাই পীর সাহেবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সব সময় ঐক্যের পক্ষে। ঐক্যের জন্য আমরা যে কোনো ছাড় দিতে সব সময় প্রস্তুত। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনি জোট বা সমঝোতার যে আলোচনা বাজারে চলছে, আসলে বাস্তবতা হলো-এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের অফিশিয়াল কোনো বৈঠক হয়নি। আমরা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক বাক্স নীতি নিয়ে কাজ করছি এবং তা চলমান। ইসলামপন্থির বাইরেও ইসলাম, দেশ ও মানবতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ১০টি। এর বাইরেও কয়েকটি অনিবন্ধিত ছোট দল সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। অতীতে একাধিকবার এ দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ার চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। তবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নতুন বাস্তবতায় আবারও ইসলামি দলগুলোর ঐক্যচেষ্টার আলোচনা সামনে এসেছে। উৎস: যুগান্তর।